যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বই : কপালকুণ্ডলা
লেখক : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
রিভিউ করেছেনঃ সৈয়দ রেজওয়ান সিদ্দিক
প্রকাশকাল
‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন। এই উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেন মেজভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। এই উপন্যাসের একটি কথায় কানে সর্বত্র অনুরানিত হয়— “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?” এই অধম বা উত্তমের সন্ধান করেছেন লেখক নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মধ্য দিয়ে।
‘কপালকুণ্ডলা’ নামকরণ
কপালকুণ্ডলা নামকরণের সাথে কপালকুণ্ডলার বিশেষ সম্পর্ক আছে। কপালকুণ্ডলার সাথে যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় নবকুমারের তার বর্ণনা লেখক করেছেন, “নবকুমার আকস্মাৎ এইরূপ দুগমধ্যে দৈবী মূর্তি দেখিয়া নিস্পন্দশরীর হইয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার বাকশক্তি রহিত হইল,–স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিলেন…অনেক্ক্ষণ পরে তরুণীর কণ্ঠস্বর শুনা গেল। তিনি অতি মৃদুস্বরে কহিলেন, পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?” এভাবে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে প্রবেশ করলো। হয়ে উঠলো প্রধান চরিত্রে।
নামকরণ তিনভাবে হয়ে থাকে। যথা:-
ক★ ঘটনাকেন্দ্রিক নামকরণ
খ★ চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ
গ★ ব্যঞ্জনাকেন্দ্রিক নামকরণ
কপালকুণ্ডলা চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ। স্বয়ং লেখক নায়িকার সাথে একাত্ম হয়ে, কখনো দ্বৈত হয়েছেন। সব মিলে এটি নায়িকা কেন্দ্রিক উপন্যাস হয়ে নামকরণ স্বার্থক হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ পুতুল নাচের ইতিকথা রিভিউ PDF | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস সমালোচনা
গল্পের পটভূমি ও সংক্ষেপ
বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেবুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নেগুয়ায় ছিলেন। এখানে বসবাসকালে এক সন্ন্যাসী সমুদ্রতীরের জঙ্গলে বাস করতো। এই কাপালিককে দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। পূর্ণচন্দ্রের বিবরণ থেকে আরও জানা যায় যে, নেগুয়া থেকে বদলি হয়ে খুলনা যাবার আগে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র একদিন সঞ্জীবচন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্রকে জিজ্ঞেসা করেন,…’যদি শিশুকাল হইতে ষোল বৎসর পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক সমুদ্রতীরে বনমধ্যে কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিত হয়, কখনও কাপালিক ভিন্ন অন্য কাহারও মুখ না দেখিতে পায় এবং সমাজের কিছুই জানিতে না পায়, কেবল বনে বনে সমুদ্রতীরে বেড়ায়, পরে সেই স্ত্রীলোকটিকে কেহ বিবাহ করিয়া সমাজে লাইয়া আইসে, তবে সমাজ সংসর্গে তাহার কতদূর পরিবর্তন হইতে পারে এবং তাহার উপরে কাপালিকের প্রভাব কি একেবারে অন্তর্হিত হইবে?’
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, “Floating straight obedient to the stream.”
একদল লোক নৌকায় যাচ্ছে। তাদের ক্ষুধা লাগে। কিন্তু রান্না করার জ্বালানি নেই। নৌকা থাকে। কেউ ভয়ে বনে যায় না। তাদের ধারণা, বনে বাঘ আছে। গল্পের নায়ক নবকুমার সাহস করে বনে চলে যায়। কিন্তু তাকে রেখে তার সঙ্গীরা চলে যায়। সে ক্লান্ত হয়ে একসময় বালুর উপরে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে যখন ঘুম ভাঙে সে দেখে দূরে আলো জ্বলছে। সেখানে গিয়ে দেখে একজন কাপালিক বসে আছে। কাপালিক তাকে একটা কুঁড়ে ঘরে রেখে চলে যায়। পরেরদিন সে বের হয় কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেলে। আচমকা শুনতে পায় এক নারী কণ্ঠ, “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”
এই নারীটি কপালকুণ্ডলা। এই উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র। কপালকুণ্ডলা আসলে দান্তের বিয়াত্রিচে, গ্যাটের শ্বাশত নারী, শেলীর এমিলিয়াভিভানিয়া কিংবা রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠানের মত নয় কিন্তু নবকুমারের জীবনে এক রহস্যময় সৌন্দর্যময়ী ব্যক্তিত্বের প্রেরণাময়ী। এই উপন্যাসটির পটভূমি মেদিনীপুরের কাঁথি অঞ্চলের সমুদ্রতীরে। নির্জন সেই বনের মধ্যে নির্মম ধর্মাশ্রয়ী কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিত নিসঃঙ্গ কপালকুণ্ডলা। সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনে একমাত্র কাপালিক তার পরিচিত। যৌবনের সন্ধিক্ষণে যুবক নবকুমারের সাথে তার দেখা। তারপর কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় নবকুমার। সমাজবিচ্ছিন্ন একটি মেয়ে লোকালয়ে কেমন করে নিজেকে অ্যাডাপ্ট করে? কী হয় তার পরিণতি?
আরও পড়ুনঃ দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক PDF রিভিউ | প্রেক্ষাপট | পটভূমি | আলোচনা
পাঠ প্রতিক্রিয়া
আমি পাঠ প্রতিক্রিয়াকে কয়েকটি ভাগে বর্ণনা করেছি।
বিশ্বসাহিত্যের সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচিতি:-
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যের সাথে কতটা সম্পর্ক রাখতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় কপালকুণ্ডলায়। এ উপন্যাসের প্রতি পরিচ্ছদের শীর্ষে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি উদ্ধার করেছেন তিনি। এসব উদ্ধৃতির মধ্যে তাঁর সমকালীন দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্তের উদ্ধৃতি যেমন আছে, তেমনি শেক্সপিয়ার, বায়রন, কিটস, শ্রীহর্ষ, কালিদাস প্রমুখের।
আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে পারি যে বাংলা ভাষার গদ্যে কপালকুণ্ডলার সদৃশ্য সুচারু গ্রন্থ এখনো মুদ্রিত হয়নি। যেকোনো ভাষার যেকোনো গ্রন্থকার এরূপ উন্নতমানের রচনা প্রকাশ করতে পারলে প্রশংসার দাবিদার। এটি একটি রোমান্টিক উপন্যাস। কপালকুণ্ডলার সাথে নবকুমারের যে প্রণয়, কে জানে হয়তোবা বঙ্কিমচন্দ্র সুখোচ্ছলে আপন জীবনকে পরিবেশন করেছেন কি না। গ্রন্থটিতে গার্হস্থ্যজীবনের ছাপ প্রধান স্থান অধিকার করেছে। যে নিগূঢ় ভাবসঙ্গতি শ্রেষ্ঠ রোমান্সের লক্ষ্মণ, যে অনিবার্য ঘটনা পরিণতির একমুখীতা মহৎ ট্র্যাজেডির প্রাণশক্তি সেই উভয়বিধ উৎকর্ষতা এই উপন্যাসে আছে। এই উপন্যাসে নায়িকার আত্মপ্রকৃতি উদঘাটন এর প্রধান উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুনঃ গল্পগুচ্ছ Read Online | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | Golpo Guccho PDF
প্রধান তিন উক্তি:-
ক★ “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”
খ★ “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”
গ★ “প্রণয় কর্কশকে মধুর করে, অসৎকে সৎ করে, অপুণ্যকে পুণ্যবান করে, অন্ধকারকে আলোকময় করে!”
মাঝেমাঝে উপন্যাসের কিছু লাইন এমন করে মূর্তি হয়ে মনের মধ্যে বসে যে সেটা সারাজীবন আমরা বহন করি। কপালকুণ্ডলা পড়তে গিয়ে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়। ভার্সিটি এডমিশন দেওয়ার কারণে এই উক্তিগুলো আমি অন্য বইয়ে পড়েছি। কিন্তু যখন সরাসরি উপন্যাসে পড়লাম সেটার অভিজ্ঞতা ছিলো এলোমেলো। সহজ পাঠকের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উক্তিটি পড়ার চিন্তা সুখোকর এক স্মৃতি। এই বইয়ের উক্তিগুলোর আকাশ ছোয়া জনপ্রিয়তা। এই উপন্যাসটি পড়ার অন্যতম কারণ এটির উক্তিগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ।
আরও পড়ুনঃ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনী | ১ম পর্ব | সম্পূর্ণ জীবন কাহিনী | Sukanta
ঐতিহাসিক সত্য বনাম কপালকুণ্ডলা :-
গ্রন্থটির তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে শুরু হয় ইতিহাসের সংযোগ, ইতিহাসের কিছু পালা বদলের কাহিনি যা লেখক যুক্ত করেছেন নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার জীবনের সাথে।
মোঘল সম্রাটের রাজ দরবারের কথা তিনি স্থান দিয়েছেন উপন্যাসটিতে। বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের শরীরে কল্পনার রঙ মিশিয়ে উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাস ও ব্যক্তিগত জীবনের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ এটি। অবশ্য তাঁর ঐতিহাসিক চিত্রের মধ্যে অনেক ফাঁক ও ক্রটি আছে। তিনি ইংরেজি উপন্যাসের আলোকে তাঁর তাঁর মৌলিক রচনাগুলো উপহার দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে। পাশ্চাত্য দেশের তুলনায় তাঁর ইতিহাস দায়িত্বজ্ঞানহীন কাল্পনিকতা ও তথ্যহীন সঙ্কেতের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এর জন্য শুধু বঙ্কিমচন্দ্র একা দায়ী নয়, আমাদের দুর্ভাগা দেশে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের বড়ই অভাব।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে রাজা বা রাজবংশের ভাগ্যকে বিড়ম্বিত করেছে কিন্তু সাধারণ পারিবারিক জীবনে এই ঝটিকা বিপর্যস্ত করে নাই। লেখক যখন ইতিহাসের গল্পের সাথে নবকুমার ও কপালকুণ্ডলাকে যুক্ত করে, তা মোটেও সংযোগ ঘটেনি। যেমন তেল আর পানি মিশে না। এমন লেগেছে। যেন জোর করে ঢুকে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের এই অংশ। সেই সময়ের দেশের অবস্থা কেমন ছিল, সেটা সন্তোষজনক বিবরণ ইতিহাসে নেই। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে বলা যায় যে, এটা উপন্যাসে থাকবে না। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির ইতিহাস নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যেখানে যা পেয়েছেন তা প্রবন্ধ কিংবা উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। যতটা ফাঁক আছে, তা কল্পনা দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ যে বইগুলো জীবনে একবার হলেও পড়া উচিত | ৫০০ বইয়ের তালিকা
উপন্যাসের ভাষা ও সংলাপ :-
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে আমি প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিড়াল’ নামে একটি ছোটোগল্প পড়ি আমার পাঠ্যবইয়ে। সেখানেই বুঝেছিলাম, লেখকের ভাষা গড়পড়তা নয়। সাধু ভাষায় লেখেন। কপালকুণ্ডলার মাধ্যমে তাঁর উপন্যাস পড়া শুরু। সত্যি বলতে, আমার অজ্ঞাতার কারণে এই উপন্যাসের ভাষা বুঝতে নানাবিধ সমস্যা হয়েছে। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় চার লাইনের একটি কবিতা আছে। আমি একটা লাইনও বুঝতে পারি না।
“দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী
তমালাতালীবনরাজিনীলা
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশে
র্দ্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।।”
উচ্চারণ করতে যখন দাঁত ভেঙে যায় তখন বোঝা তো বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু না। যদিও এই উচ্চাভিলাষী ধ্রুপদী উপন্যাসটি যুগে যুগে বাংলা সাহিত্যকে দেখিয়েছে আলো।
উপন্যাসে থাকবে টানটান উত্তেজনা, এক পৃষ্ঠা শেষ করার পর আরেক পৃষ্ঠা পড়ার জন্য ব্যাকুলতা থাকবে। কিন্তু অতি উন্নত ভাষা উপন্যাসটির উত্তেজনাকে আহত করেছে। বলে রাখা ভালো, টানটান উত্তেজনা আপেক্ষিক একটি ব্যাপার।
আরও পড়ুনঃ মেঘনাদবধ কাব্য PDF | Meghnath Vadh Kabbo Summary in Bengali
আমি জানি প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে প্রথম চলিত ভাষায় সাহিত্য চর্চা করার জোর তাগিদ জানায়। তার আগে সবাই সাধু ভাষায় লিখতো। সে সময় এই উচ্চাভিলাষী ভাষা ছাড়া সাহিত্য চর্চা হতো না। তাই হয়তো বঙ্কিমচন্দ্র এটি সংলাপে ব্যবহার করেছেন।
রাজদরবারে মানুষ যেমন করে কথা বলছে, একইভাবে একজন কাপালিকও কথা বলছে। আশ্চর্য হবেন যখন দেখবেন, সবাই সাধু ভাষায় কথা বলছে। কীভাবে সম্ভব? একজন নিম্নমানের মানুষ থেকে একজন উচ্চমানের মানুষ সবাই একইভাবে কথা বলছে। কথা বলার সময় কখনো কি মানুষ সাধুভাষা ব্যবহার করতো? আমার এ সম্পর্কে জানা নেই।
সংলাপগুলো সব শক্তিশালী। তবে স্থানভেদে, মানুষভেদে যে ভাষার ব্যবহার ভিন্ন হয়। এটা যদি উপন্যাসে ফুটে উঠতো তাহলে ভাষা প্রাণ ফিরে পেতো। এই সামান্য ব্যাপারটিকে দূরে সরিয়ে রাখলে কপালকুণ্ডলা মন্দ নয়।
আরও পড়ুনঃ সংস্কৃত নবরঙ্গ থেকে ইংরেজি Orange | কমলা | বাংলা ভাষার বিবর্তন
কাঁঠালপাড়ার কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় :-
বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়ার মাটির কবি- এর মধ্যে ভালো বা মন্দ যা তিনি দেখেছেন জীবনে, দিনের পর দিন যে মানুষগুলোকে শিশু থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত দেখেছেন তারই চিত্রায়ন করেছেন। কপালকুণ্ডলার প্রশংসা করে অক্ষয়চন্দ্র সরকার লেখেন, “এমন অচ্ছিদ্র, উজ্জ্বল, বাচালতাশূণ্য, অথচ রস পরিপূর্ণ, বিন্দুভাবে অস্থিমজ্জায় গঠিত, অদৃষ্টবাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখায় ওতোপ্রোতো – কাব্যগ্রন্থ।” বঙ্কিমচন্দ্র অসাধারণ কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন গল্পের প্রসঙ্গে, যা চমৎকৃত করে পাঠককে।
কী অনবদ্য সংলাপের মাধ্যমে কবিতা শুরু হয়। কপালকুণ্ডলাকে যখন তার ননদ বলে, মেয়েমানুষের পরশপাথর পুরুষ। পুরুষের বাতাসে যোগিনীও গৃহিণী হইয়া যায়। তারপর কবিতা-
“বাঁধার চুলের রাশ,
পরাব চিকন বাস,
খোঁপায় দোলাব তোর ফুল।
কপালে সীঁথির ধার,
কাঁকালেতে চন্দ্রহার,
কানে তোর দিব জোড়া দুল।।..”
আমরা অনেকে জানি না কিন্তু এটা সত্য যে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকাশিত একটি কবিতার বইও আছে। তিনি সংবাদ প্রভাকরে কবিতা ছাপাতেন। কপালকুণ্ডলায় একের এক কবিতা, গ্রন্থটিতে মহিমান্বিত করে তোলে।
আরও পড়ুনঃ কমলাকান্তের দপ্তর প্রবন্ধ পিডিএফ | Komola Kanter Doptor PDF
চরিত্রায়ণ:-
ঘটনার মূল লক্ষ্য চরিত্র সৃষ্টি। ঔপন্যাসিক তাঁর বর্ণনাভঙির মাধ্যমে নাটকের মত চরিত্র সৃষ্টি করেন, তাই উপন্যাসকে বলা হয় পকেট থিয়েটার।
নবকুমার জীবন আবর্তিত হয় দুজন নারীকে ঘিরে। একজন কপালকুণ্ডলা, আরেকজন লুৎফ-উন্নিসা। একজন ঘরের আরেকজন বাইরের। “আমরা যাহাকে ভালোবাসি কেবল তাহার মধ্যে এমন পরিচয় পাই। এমনকি জীবনের মধ্যে অন্তরকে অনুভব করার নাম ভালোবাসা।” এ কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নবকুমারের জীবনে এমন ভালোবাসা এসেছিলো যা তাকে প্রেরণা দিয়েছে, প্রাণ রক্ষা করেছে। তার জীবন বৃত্তের দুদিকে আছে, দুই রূপের সন্ধান। কপালকুণ্ডলা আর লুৎফ-উন্নিসা যেন দুটি পাখি। একজন খাঁচার শিকে মাথা কুটে নিঃশেষ। আর অন্যজন উড়ে উড়ে নীড় খুঁজে পেল না। এই দুই চরিত্র স্বতন্ত্র দুই গল্পের নায়িকা হলোও তারা কৃত্রিমভাবে জোড়া লেগে যায়। জোড়া লাগানোর সূত্র নবকুমারের প্রতি উভয়ের প্রেম। প্রধান এই চরিত্রগুলো এভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত | বাংলা সাহিত্যে অবদান | জীবনী
এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র বলতে একদিকে কপালকুণ্ডলা, নবকুমার ও লুৎফ-উন্নিসা অপরদিকে পদ্মাবতী, মতিবিবি। এছাড়া শ্যামাসুন্দরী ও কাপালিক প্রমুখ পার্শ্বচরিত্র রয়েছে।
চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে লেখক প্রদর্শন করেছেন শিল্পনৈপুণ্য। এই উপন্যাসে শুধু প্রধান চরিত্রগুলোকে নিয়ে গল্প এগিয়ে যায়নি পার্শ্বচরিত্রগুলোও মূল কাহিনির একমুখীতায়র সাথে সম্পৃক্ত।
আমরা যখন কোনো উপন্যাস পড়তে বসি, তখন কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ার পর আমরা অনুমান করার চেষ্টা করি উপন্যাসের পুরো কাহিনি সম্পর্কে। কিন্তু লেখক যখন স্বয়ং বাংলা উপন্যাসের সৃষ্টা তখন যতই চেষ্টা করি না কেন পুরোটা সময় জুড়ে তাঁর বইয়ের সাথে থাকতে হবে, তারপর বুঝতে পারব ঘটনা। দারুণ গতিশীল এক বর্ণনায় লেখক চরিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন নানা প্রেক্ষাপটে ও সামাজিক অবস্থান থেকে ।
কপালকুণ্ডলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক তার বক্তব্যকে পরিস্ফুট করার আগ্রহে ওই চরিত্রের ওপর অধিকমাত্রায় আলো ফেলেছেন। এছাড়াও এ উপন্যাসে স্বল্প কালপরিসরে হলেও অন্য কিছু চরিত্রকেও তিনি স্পষ্টরূপে রূপায়িত করেছেন এবং উন্মোচন করেছেন তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতা। যেখানে আছে ভদ্র মানুষ তেমনি আছে কাপালিকের মতো অনিয়ম আর অসংগতিতে পরিপূর্ণ মানুষও।
লেখক এ উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা চরিত্রকে একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতি দানের লক্ষ্যে যেভাবে অন্য চরিত্রের সংস্পর্শে এনে তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।
আরও পড়ুনঃ হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির লেখক কে? সম্পূর্ণ কবিতার আসল রচয়িতা কে?
শেষ কথা
শুটিং সেটের ক্যামেরাটা দর্শকের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র গল্প বলেছেন। ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এ তলস্তয় যুদ্ধক্ষেত্রকে এত কাছ থেকে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেন যে পড়তে পড়তে পাঠক ওটাকে বাস্তব বলে ধরে নেয়। এমনি এক বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পাঠক যায়, যেন নিজের চোখের সামনে অঙ্কিত হচ্ছে জটিল আর অবিনাশী একটি শিল্পকর্ম। শিল্পের এ নির্মাণ জীবনের বিপরীতে আরেক জীবন।
ক্লাসিক সাহিত্য মানুষের চিন্তা ভাবনার ব্যাপক পরিবর্তন করে। এখনো মনে পড়ে অনেকদিন আগে আমার পড়া প্রথম ক্লাসিক উপন্যাসের কথা। সেটা ছিলো রবিঠাকুরের “ঘরে বাইরে”। আমি এটা পড়ার আগে পর্যন্ত জানতাম না যে এক একটা চরিত্রের আত্মকথা দিয়েও উপন্যাস লেখা যায়। সে এক মধুর অভিজ্ঞতা ছিলো।
এরপর দীর্ঘসময় কেটে গেছে। অনেক ক্লাসিক পড়েছি। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি। সম্প্রতি পড়লাম কপালকুণ্ডলা। এভাবেও উপন্যাস লেখা যায়। প্রতিটি পরিচ্ছেদ শুরু হচ্ছে, তার আগে একটি করে বিখ্যাত লেখকের উদ্ধৃতি। বলা যেতে পারে ওই উদ্ধৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে পরিচ্ছেদটির সারসংক্ষেপ। আমার মত স্বল্প পড়ুয়া পাঠকের কাছে এটা একটা অভিজ্ঞতা। দুটি ভিন্ন গল্পকে কীভাবে জোড়া লাগাতে পারে নিখুঁত লেখকেরা আমাদের জানতে হলে চোখ রাখতে হবে উপন্যাসটির পাতায়। অসামান্য উপন্যাসটির জন্য পুরো বাংলা সাহিত্য আপনার কাছে ঋণী হে মহান লেখক। আপনাকে ধন্যবাদ।
আরও পড়ুনঃ নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের রুপাই চরিত্রের বাস্তব পরিচয় ও জীবনী