যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বিজন ভট্টাচার্যের লেখা “নবান্ন” নাটকটি-তে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের চিত্র ফুটে উঠেছে যেখানে বাংলায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ অনাহার, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগ-শোকে প্রাণ হারিয়েছে। চাষি প্রধান সমাদ্দার নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ) তার পরিবার কেমন অনাহারে ও কষ্ট পেফয়েছিল, তা-ই এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু।
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ‘নবান্ন’ নাটকটি ১৯৪৪ সালে রচনা যা ১৯৪৪ এর ১২ই মে ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় । ১৯৪৪ সালেই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়, প্রকাশক – গিরীন চক্রবর্তী, পূরবী পাবলিশার্স। বিজন ভট্টাচার্য ‘নবান্ন’ নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন – আমিনপুরকে। এই আমিনপুর আসলে মেদিনীপুর। নাটকটিতে ৪’টি অঙ্ক রয়েছে। অঙ্কগুলো (৫+৫+২+৩) মোট ১৫টি দৃশ্যে বিন্যস্ত । নাটকটি ২৪শে অক্টোবর, ১৯৪৪ সালে ‘গণনাট্য সঙ্ঘে’র প্রযোজনায় ‘শ্রীরঙ্গম’ নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয় । কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রধান সমাদ্দার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং বিজন ভট্টাচার্য । মঞ্চনাটকের পরিচালক ছিলেন শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য এবং উপদেষ্টা ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য । এরপর আরও দু’টি মঞ্চে নাটকটি অভিনীত হয় ।
‘বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় এই নাটকের গল্পাংশ রচিত এবং সমাজের একেবারে নিচের তলায় বাঙলার সেই দুঃস্থ কৃষকদের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে । নাটকটি সত্যিই গণজীবনের প্রতিচ্ছবি।
‘নবান্ন’ নাটকটি মহামন্বন্তরের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) সময়েই লেখা হতে থাকে । নাটকের বিষয়বস্তু আদ্যোপান্ত এই মন্বন্তর । মন্বন্তরের বিপর্যয়ই এই নাটকের বিষয়ের শেষ কথা নয়। মন্বন্তর শেষে বেঁচে থাকা গ্রামবাংলার মানুষ শহর থেকে আবার নিজের গ্রামে ফিরে এসে নতুনভাবে, নতুন করে সঙ্ঘবদ্ধভাবে বাঁচবার শপথ নিয়েছে।
মন্বন্তরে মৃত্যুর মুখোমুখি মানুষেরা, মন্বন্তর শেষে গ্রামে ফিরে নতুন ধান্যে ‘নবান্ন’ উৎসব করেছে । মানুষের এই নতুন করে বেঁচে ওঠার জয়গান এই নাটকে রয়েছে বলে, নাটকের বিষয়বস্তু মন্বন্তর হলেও, ‘তিমির-বিনাশী’ প্রত্যয়ের কারণেই নাটকের নামকরণ হয়েছে নবান্ন’ ।
আরও পড়ুনঃ সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মূলভাব | সংক্ষিপ্ত আলোচনা | নোট | বিষয়বস্তু
মানুষ থেকে ভিখারী, কালোবাজারী, ধনীর উন্মত্ত আমোদ, ভিটে থেকে উৎখাত, নারী পাচার, ধন-সম্পদ লুট, ফসল লুট, কৃষক শোষণ, বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার, মন্বন্তর ইত্যাদি সঠিকভাবে চিত্রিত করেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। শহর-গ্রামের শোষণকারীদের মধ্যে যে শ্রেণীস্বার্থগত কোনও পার্থক্য নেই, এই সত্যটিও দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। শোষণের বিরুদ্ধেই উচ্চারিত হয়- ‘জোর প্রতিরোধ এবার প্রধান ‘- এই শ্লোগানের মধ্যেই নতুন আন্দোলনের শুভ সূচনার ইঙ্গিত দেয়।
‘নবান্ন’ যথার্থই একটি অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বাশ্রয়ী গণনাটক । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতবর্ষের গ্রাম-শহরের যাবতীয় সংকট ও শোষণের নানা চেহারা বুঝতে ‘নবান্ন’ পাঠ ও তার অভিনয় দেখা খুবই জরুরী । এই নাটকে আপাততভাবে প্রধান সমাদ্দার নামক একটি চাষী পরিবারের জীবন সমস্যা আঁকলেও এটি অবিভক্ত বাংলার গ্রাম-শহরের উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত-দরিদ্র মানুষের জীবন্ত দলিল। অব্যশই বাংলা নাটকের প্রথাবদ্ধ চরিত্রচিত্রণ থেকে সরে এসে নাট্যকার গণমুখী চরিত্র উপহার দিয়েছেন ।
এই নাটকের ৪৫টি চরিত্রই সমকালীন শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রতিনিধি । গণনাট্যে নায়ক চরিত্র আসলে সম্মিলিত সংগ্রামী চরিত্র । দয়াল চরিত্র অত্যধিক প্রাধান্য না পেলে এ নাটকে আমরা গোষ্ঠীনায়কের সাক্ষাৎ পেয়েছি । নাট্যকারের স্থানানুযায়ী, চরিত্রের মানসগঠন অনুযায়ী, পরিবেশ অনুযায়ী সংলাপ রচনার কৌশল, সমবেত সংগীত ব্যবহার ও নাট্য শিল্পশৈলীর সাফল্য প্রয়োগ হয়েছে ‘নবান্ন’ নাটকটিতে ।
আরও পড়ুনঃ মেঘনাদবধ কাব্য PDF | Meghnath Vadh Kabbo Summary in Bengali
‘নবান্ন’-র নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৭ই জুলাই, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার (বর্তমান বাংলাদেশ) খানখানপুর গ্রামে। পিতা ক্ষীরোদ বিহারী ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তাঁর আদর্শ জীবনযাত্রা, সাহিত্য ও সংগীতপ্রীতি এবং শেক্সপীয়র-চর্চায় অনুরাগ বিজন ভট্টাচার্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পিতার সঙ্গে নানা স্থানে পরিভ্রমণ কালে গ্রামের মানুষদের দৈনন্দিন জীবন ও তাঁদের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেছিল। এখানে যাত্রা, কথকতা ও মেলায় অংশগ্রহণ করায় বিজন ভট্টাচার্যের গ্রামজীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল অতিশয় সমৃদ্ধ। মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আশুতোষ কলেজে পরে রিপন (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩১-৩২-এ শরীর চর্চা, জাতীয় আন্দোলন, পরে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অবসর সময়ে আলোচনা, ফিচার ও স্কেচ লিখতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত ‘অরণি’ পত্রিকায় যোগ দিয়ে গল্প ছাড়াও নানা বিষয়ে লিখতেন। রেবর্তী বর্মনের সাম্যবাদ সম্পর্কিত বই পড়ে কমিউনিস্ট মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯৪২-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সর্বক্ষণের কর্মী হন। অনিয়মিত জীবনযাপন ও অযত্নে তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন।
১৯৪২-এর ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন, ‘জনযুদ্ধ’ নীতির প্রচার এবং ফ্যাসী বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ স্থাপন এবং সেখান থেকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সজঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্গ (IIPTA) গঠন-এ তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাঁর প্রথম নাটক ‘আগুন’ (১৯৪৩)। বিনয় ঘোষের ‘লাবরেটরী’র তিনি নাট্যরূপ দেন। এগুন্সি অভিনীত হয়। এরপর তাঁর নাটক ‘জবানবন্দী’ অরণি তৈ প্রকাশিত হয় আর দুর্ভিক্ষ ও মম্বন্তরের পরিপ্রেক্ষিতে রচনা করেন ‘নবান্ন’। এটি ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৪- এ আই. পি. টি. এ. কর্তৃক শ্রীরঙ্গন মঞ্চে অভিনীত হয়। নাটকটিতে তিনি প্রধান সমাদ্দারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
আরও পড়ুনঃ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনী | ১ম পর্ব | সম্পূর্ণ জীবন কাহিনী | Sukanta
ইত্যবসরে ১৯৪৩-এ তিনি খ্যাতনামাকবি ও গল্পলেখক মনীয ঘটকের কন্যা, লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীকে বিয়ে করেন, তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় পটভূমিকায় বিজন ষ্টাচার্য ‘জীয়নবন্যা’ লেখেন। ‘মরাচাঁদ’ নাটকে পবন বাউলের ভূমিকায় উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে সবিশেষ খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। ১৯৪৮-এ তিনি মতান্তরের কারণে গণনাট্য সত্য ছেড়ে বোম্বাই চলে যান জীবিকার অন্বেষণে। সেখানে তিনি কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন এবং কয়েকটি চিত্রনাট্য রচনা করে দেন।
১৯৫০-এ কোলকাতায় ফিরে ‘ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে প্রায় ২০ বছর ধরে নাটক লিখে, অভিনয় করে, নাটক পরিচালনা করে জীবন ধারণ করেছেন। দেবী দুর্গার রূপকাশ্রয়ে জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষকের সম্মিলিত প্রতিরোধ রচনার জন্য ‘দেবীগর্জন’, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় ‘কলঙ্ক’, দেশবিভাগের দরুণ বাস্তুচ্যুত শিক্ষকের জীবন নিয়ে ‘গোত্রান্তর’ রচনা করেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ ছেড়ে ‘কবচকুণ্ডল’ নামে একটি নাট্যপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানেও কয়েকটি নাটক অভিনীত হয়েছে – যেমন, ‘কৃদ্মপক্ষ’, ‘আজ বসন্ত’ প্রভৃতি। বিজন ভট্টাচার্য উৎপল দত্ত পরিচালিত লিটল থিয়েটার গ্রুপের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, দিলীপ 194 রায় নির্দেশিত ‘রাজদ্রোহী’-তে অভিনয় করা ছাড়াও বাড়ী থেকে পালিয়ে’, ‘তথাপি’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। বস্তুত নাটক, গান, অভিনয় ছিল বিজন ভট্টাচার্যের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে ওতোপ্রোত। তথাপি, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন ও হতাশা, তাঁর অসামান্য প্রতিভা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সফল সুন্দর জীবন উপকূলে পৌঁছে দিতে পারেনি।
আরও পড়ুনঃ দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক PDF রিভিউ | প্রেক্ষাপট | পটভূমি | আলোচনা
আরও পড়ুনঃ বিসর্জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | বিষয়বস্তু | Bisorjon Natok PDF Download