যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বইঃ প্রথম প্রতিশ্রুতি (সত্যবতী ট্রিলজির ১ম খণ্ড)
লিখেছেনঃ আশাপূর্ণা দেবী
রিভিউ করেছেনঃ Jannatul Firdous
“এতো আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এতো অন্ধকারে কেন?”
আঠারো-উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা সত্যবতী ট্রিলজি এর প্রথম বই “প্রথম প্রতিশ্রুতি” তে আশাপূর্ণা দেবী তুলে ধরেছেন তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান। সে সময় যখন নারীরা সমাজ এবং ধর্মের শেকলে বন্দী হয়ে নিজেদের আবেগ, অস্তিত্ব, অধিকার ভুলে শুধু সংসারের সবার মন জয় করতে ব্যস্ত, তখন রামকালী চাটুয্যের কন্যা সত্যবতী সেই সংসারের শেকল ভাঙতে হয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই বন্দী জীবনের সংস্কার থেকে বেরিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সত্যবতীর সংগ্রামের গল্পই উঠে এসেছে বইটিতে। প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ১৯৭৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করে।
একটা ভালো বই পড়বার সময়টাকে অনেক সময়ই পাঠকের কাছে স্বর্গসুখ বলে মনে হয়। এই বইটা পড়বার সময় আমার অনেকটা তেমন অনুভূতি হচ্ছিলো। শুধু গল্প পড়বার জন্যেই পড়া শুরু করলেই এই বইটা থেকে জীবনের অনেক কিছু আমি শিখেছি। সেই সাথে মনে হয়েছে, বইটা আগে পড়া উচিত ছিল। শিক্ষাগুলো তাহলে আগেই কাজে লাগাতে পারতাম।
প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসের বিষয়বস্তু
মূল গল্পে আসি, নায়িকা সত্য তখনকার কঠিন সমাজের বামুনের মেয়ে। তার বাবা বিখ্যাত রামকালী কবিরাজ তার নিজের গ্রামসহ আরো সাতটা গ্রামের মাথা। সত্য তার একমাত্র মেয়ে। সত্যর শত উড়নচন্ডিপনা তাই প্রশ্রয়ের চোখে দেখেন তার বাবা। আরো একটা কারণে ‘তুচ্ছ মেয়েমানুষ’ হওয়া সত্ত্বেও সত্যকে তিনি প্রশ্রয় দেন,সেটা হচ্ছে সত্যর গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলার ক্ষমতা। আশেপাশের কারো সাথে অন্যায় হওয়া দেখলেই সত্য জোর গলায় প্রতিবাদ করে। এমন উত্তর দেয় যে বড় বড় মানুষগুলোও বাক্যহারা হয়ে যায়,
“মেয়েদের বই ধরলে পাপ হয় কেন? বিদ্যের দেবী সরস্বতী কি মেয়ে নয়?”
“সতীন যদি বোনের মতোই হবে তাহলে সতীন কাঁটা নিয়ে মন্ত্র পড়তে হয় কেন আমাদের?”
“অল্পবয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে যখন বুক কাঁপেনি তখন মেয়েকে শ্বশুরঘরে পাঠাতে আর দুঃখ করছো কেন?”
এরকম নানা প্রশ্নবানে তার বাবাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করে না সত্য, দ্বিধায়ও ফেলে দেয়।
রামকালী কবিরাজ তখনকার সমাজের মানুষের মতো অন্ধ ছিলেন না। ঠিক ভুল জ্ঞান ছিল তার, অন্যায় করতে তারও বুক কাঁপতো। তাই মেয়ের এই সত্যবাদীতা বারবার তাকে মুগ্ধ করতো।
সত্য! প্রতিবাদী সত্য। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করা সত্য।অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করে সবার চোখে খারাপ হওয়া সত্য।
বিয়ে তারও আর পাঁচটা মেয়ের মতো ছোট বয়সেই হয়ে গিয়েছিলো। শ্বাশুড়ি দজ্জাল বললে ভুল হবে, রীতিমত রনচন্ডী। সত্য এদিকে ভালোর ভালো খারাপের খারাপ। ননদ সৌদামিনীর সাথে যেমন তার মধুর ব্যবহার শ্বাশুড়ির সাথে তেমন তিক্ত সম্পর্ক। কারণ শ্বাশুড়ির অত্যাচার সেও মুখ বুজে সহ্য করতে রাজি না।
সত্যর স্বামী ভালোও না খারাপও না। মায়ের ভয়ে যেমন ভীত বৌয়ের ভয়েও তেমনি ভীত। কিন্তু সত্য কাউকে ভয় পায় না। সে তার ছুত বাতিকগ্রস্ত পিসিমা হোক বা রনচন্ডী সুদখোর শ্বাশুড়ি, চরিত্রহীন শ্বশুর। সবাইকে মুখের ওপর ন্যায্য কথাটা শুনিয়ে দিতে ভয় পায় না সত্য। বরকে সত্য হাতের পুতুল করে রেখেছে কথাটা ঠিক না, ভুলও না। সত্যকে কিছু করতে হয় নি,তার বরের বরাবরই স্বভাবটা এমন, শক্তের ভক্ত। যেখানে ওমন রনচন্ডী মা বৌয়ের সাথে পেরে ওঠে না সে কোন ছার?
আরও পড়ুনঃ মেঘদূত কালিদাস PDF | Meghdoot Kalidas Bengali English Sanskrit
সত্য কোনোকিছুকে ভয় পায় না। রোগে পড়লে মানত করলেই কাজ হবে এমন কথাতে বিশ্বাস করে না। জাত পাতের ভয় না করে সাহেব ডাক্তার ডাকার ক্ষমতা তার যেমন আছে তেমনই আছে সাহস, কলকাতার চামড়ার কলের জল খাওয়ার বা ব্রাক্ষ্ম ধর্মের কারো সাথে মেলামেশার, সাহস আছে জাত হারানো চরিত্র হারানো কোন আত্নীয় যাকে আর সবাই ত্যাগ করেছে তাকে নিজের বাড়ি এনে রাখার।
“মনে জানবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তোমার যদি মনে হয় তুমি ভুল করছো না তাহলে চারপাশের মানুষ তোমাকে খারাপ বললেও কিছু যায় আসে না। চারপাশের মানুষ খারাপ বলবে এই ভয়ে অন্যায়ের সাথে আপোষ করাটাও তো স্বার্থপরতা। নিজের সুনাম শোনার লোভ। সেটাই কি ভালো?”
নির্ভীক সত্য। চারপাশের মানুষ যেখানে বারবার মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় তার কাছে।
জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত এমন বই পড়েছি যেখানে নায়িকা চরিত্র সবসময় নরমসরম চুপচাপ হবে। নিজের জীবনকেও সেভাবে পরিচালিত করেছি,ভালো মানুষ সবাইকে মান্য করে চলবে আমাদের পাঠ্যবই আমাদের এমনই শিক্ষা দেয়। কিন্তু এটা শেখায় না নিজের চেয়ে বড় কেউ যদি অন্যায় করে কি করতে হবে, যদি সমাজ অন্ধত্ব কুসংস্কারের বেড়াজালে বেঁধে ফেলে সেখান থেকে বেরোতেই বা কিভাবে হবে। সত্যবতীর এই গল্পটা আমাকে অনেক বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে,সাথে অনেক কিছু শিখিয়েছে। শিখিয়েছে জীবনে সবসময় নায়িকা হয়ে থাকা যায় না, ন্যায় বা ভালোর জন্য কখনো কখনো চারপাশের মানুষের চোখে ভিলেনও হতে হয়। অতঃপর তারা গালি দেয়, দুর্নাম করে, আড়ালে নিন্দে করে তারপর ভুলে যায়। কিন্তু নিজের জীবনটা নিজের হাতেই থাকা উচিত, সেটাকে সমাজের হাতে তুলে দেবার কিছু নেই।
তখনকার সমাজের বড় একটা অংশ তাই করতো, অন্তঃপুর ছেড়ে বেরোতো না। বাড়ির পুরুষদের ওপর বাইরের পৃথিবীর এমনকি নিজের সব দায় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতো তারা। যদি কখনো সেই পুরুষ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যায় তাহলে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া কোন উপায়ই থাকবে না পরনির্ভরশীল সেই জীবদের। সেখানে সেই ভয়ঙ্কর জটিল সমাজে সত্য সবার বিরুপ হয়ে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়েছে,কারো ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেনি। নিজেরটা নিজে গুছিয়ে নিয়েছে। সত্য শিক্ষয়িত্রী।
এই বইটা থেকে আমি যা শিখলাম সারাজীবন মনে রাখবো। এবং আমি মনে করি সব মেয়েদেরই এই বইটা টিনএজেই পড়ে ফেলা উচিত। যদিও তখনকার সমাজ আর এখনকার সমাজ অনেক আলাদা তারপরেও জীবন সম্পর্কে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে বইটা।
রেটিং ৫/৫ লেখনী, গল্প সবকিছু অসাধারণ ছিল।
আরও পড়ুনঃ কবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় PDF | Kobi Tarashankar Bandopadhyay
প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী
রিভিউ করেছেনঃ Sajjad Sajol
আঠারো এবং উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসের প্রথম বই প্রথম প্রতিশ্রুতিতে তৎকালীন সমাজ এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় অদ্ভুত এক প্রাণীর অস্তিত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন। যাদের অবয়ব, অনুভূতি, আবেগ সবকিছু মানুষের মত হলেও তাদের খানিকটা ভারবাহী পশুর মত ব্যবহার করত পুরুষ শাসিত সমাজ। সেই অদ্ভুত প্রাণিটির নাম ছিল নারী। নির্মম হলেও সত্যি তৎকালীন নারীদের প্রতি পুরুষ সমাকের আচরণ আর যাই হোক মানবিক ছিল না। হাজার বছরের মরীচা ধরা সংস্কারের শেকলে নারীরা যখন মানুষের সম্মান পায়নি তখন নিত্যানন্দপুর নামক অজপাড়া গায়ে একটি এগারো বছরের শিশুকন্যা সেই সংস্কারের শেকলে কষাঘাত করে, জানিয়ে দেয় আমরাও (নারীরা) মানুষ। আর নারী থেকে মানুষ হবার সেই শিশুকন্যার সারা জীবনের অপরাজিত সংগ্রামের গল্প নিয়েই রচিত হয়েছে প্রথম প্রতিশ্রুতি।
সত্যবতী!! হ্যা সেই এগারো বছরের শিশুকন্যাটির নাম ছিল সত্যবতী। পিতা নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ রামকালী কবিরাজ একমাত্র সন্তান সত্যবতীকে আট বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে গৌরীদানের পূণ্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরেও সংসারবদ্ধ হবার উপযুক্ত বয়সের অপেক্ষায় সত্যবতী পিতার কাছেই ছিল। বাল্যকাল থেকে সত্যবতী তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করেছিল। নির্মমভাবে সত্যকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি। শারীরিকভাবে অবোধ সত্যবতী মানুষের মানসিক সূক্ষ্মতা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করে অনেক ছোট বয়সেই। বইটির প্রথম কয়েকটি পরিচ্ছেদে সত্যবতীর পিতা রামকালীর বলিষ্ঠ বিচরণে তাঁকে এই গল্পের প্রধান চরিত্র মনে হতে পারে। কারণ সত্যবতীরর জীবনে আকাশে পিতার নামের নক্ষত্রটি ছিল সবথেকে উজ্জ্বল। পিতা কবিরাজ রামকালী নিজের পরিবারে শত মানুষের জন্য ছিলেন ভরসার আর গ্রামের সহস্র অসহায় মানুষের জন্য ছিলেন আশ্রয়ের স্থল। তারপর শৈশবের বাঁধন ছিন্ন হয় সত্যবতীর। একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাক আসে। পিতা রামকালী কন্যাকে পাঠাতে না চাইলেও পিতার সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সত্যবতী সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে চললো শ্বশুরবাড়ি।
আরও পড়ুনঃ একরাত্রি PDF | গল্পের বিষয়বস্তু সারাংশ চরিত্র
শ্বশুরবাড়ি এসে সত্যবতী হলো দিশেহারা। যেমন লোভী, মনুষ্যত্বহীন শ্বাশুড়ী এলোকেশী তেমন লালসাগ্রস্থ শ্বশুর নীলাম্বরকে দেখে সত্যবতী প্রতি পদের হয়ে দাঁড়ায় তাদের অসন্তোষের কারণ। তবে স্বামী নবকুমার ছিল যেন মাটির মানুষ। তাই তো তাঁকে বার বার ভেঙ্গে বার বার গড়ে নিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি সত্যবতীকে। সময়ের পরিক্রমায় সামাজিক রূপ বদল হয় সত্যবতীর। কন্যা থেকে স্ত্রী আবার স্ত্রী থেকে মা। নতুন রূপে নতুন ব্যক্তিত্বে নিজেকে সাজিয়ে নিতেও ভুল হয় না সত্যবতীর। সন্তানদের সুশিক্ষায় আলোকিত করতে নবকুমারকে নিয়ে কলকাতায় পারি দেয় সত্যবতী। কলকাতায় এসে সত্যবতী যুদ্ধ শেষ হয় না বরং শুরু হয়।
সত্যবতীর দূর সম্পর্কে বিধবা আত্নীয়া শঙ্করী সংস্কারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। গর্ভ অবস্থায় রেখে শঙ্করীর দ্বিতীয় স্বামী তাঁকে রেখে পলায়ন করে। সেই শঙ্করীর মেয়ে সুহাসিনীকে নিয়ে আশ্রয় হয় সত্যবতীদের ভাড়াকৃত বাড়ির মালিক দত্তদের বাড়িতে। শঙ্করীর মৃত্যুর পর সত্যবতী সুহাসকে নিয়ে আসে। সমাজে যাকে পাপের সন্তান বলে ধীক্কার দিতে ছাড়ে না সে সত্যবতীর কাছে বুকের সন্তানের মত প্রতিপালিত হয়। তারপর একদিন সত্যবতী আবার মাতৃত্ব ছোঁয়া লাভ করে। সাধন সরলের পরে এবার একটি কন্যাশিশু কোলজুড়ে আসে সত্যবতীর। নাম সুবর্ণলতা। সহস্র সংগ্রামে ক্লান্ত সত্যবতী জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্নটি দেখতে শুরু করে। নিজের কন্যাটিকে শিক্ষিত করা, যা সমাজের চোখ মহাপাপ। কিন্তু হোক পাপ। সেই পাপের মাঝেই সত্যবতী সুবর্ণলতার জন্য জীবনের আলো এনে দিতে চেয়েছিলো।
কিন্তু পেরেছিলো কি সত্যবতী? স্বপ্ন পূরণ করতে? নারীদের নিয়ে সমাজে যে পুতুলখেলা হয় সেই খেলা থেকে নিজের প্রতিচ্ছবি নিজের কন্যাকে রক্ষা করতে?
জানতে হলে পড়তে হবে সমগ্র অখন্ড ভারতের সবথেকে সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়া প্রথম প্রতিশ্রুতি বইটি।
আরও পড়ুনঃ সত্যবতী ট্রিলজি | আশাপূর্ণা দেবী | Satyabati Trilogy PDF Download
আশাপূর্ণা দেবীর জীবনী PDF [Download]