বইঃ বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প
লেখকঃ বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়)
রিভিউ করেছেনঃ Badhon Sarkar
এই ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন একজন লেখক এবং চিকিৎসক। ছোটগল্পের অনন্যসাধারণ নির্মাতা এই লেখক বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, পাঠক কে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে নারাজ, তাই তার বেশিরভাগ লেখাই ছোট “ছোটগল্প” বলা চলে। নিমগাছ, ক্যানভাসার, অমলা, পাঠকের মৃত্যু, মানুষের মন, কাক এবং আরো অজস্র জীবনঘনিষ্ঠ গল্প তার। চারটি বৃহদাকার খণ্ডে প্রকাশিত। শোনা যায় তিনি এডগার এলেন পো-র ভক্ত। ছোটগল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও তার ভান্ডারে বৃহৎ উপন্যাস-ও রয়েছে। “হাটেবাজারে”,”জঙ্গম” উল্লেখযোগ্য।
রিভিউঃ
বনফুল- ছদ্মনাম।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এই ছদ্মনাম ধারণ করে লিখতেন।
যারা সময়ের অভাবে অনেকক্ষণ টানা বই পড়ার সুযোগ পান না কিংবা পড়তে পারেন না তাদের জন্য সুখপাঠ্য বলা যায় এ বইটিকে। ছোট্ট ছোট্ট ৪৯টি গল্প রয়েছে এই বইটিতে।
এর মধ্যে ১টি গল্প পাঠ্য হিসেবে অনেকেই আগে পড়ে থাকবেন। সেটি হলো- মানুষের মন। দুই ভাই পরেশ নরেশ। তাদের ভাগ্নে পল্টু। পরেশ সংস্কৃত নিয়ে মগ্ন থাকে আর নরেশ কেমিস্ট্রি। পল্টু অসুস্থ হলে পরেশ কবিরাজ ডাকে নরেশ ডাক্তার ডাকে। দুজনের চিকিৎসাই চলতে থাকে কিন্তু কাজ হয় না। শেষে পল্টুর অবস্থা যায়যায় হয়ে উঠলে নরেশ কবিরাজ ডাকতে যায় আর পরেশ বলে ডাক্তার ডাকতে তবুও পল্টুকে বাঁচানো চাই। কিন্তু কোনো কিছুই কাজ হলো না।
ছোটবেলায় বনফুলের ‘নিমগাছ’ আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিলো। আমি ভাবতাম ওটা বুঝি কবিতা। তখন তেমন ভাবে না বুঝলেও বারবার পড়তাম, গাছটার জন্য কষ্ট হতো। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় কিন্তু এদিন আবার পড়লাম। শেষ লাইনটা সেদিন না বুঝলেও এদিন কিন্তু ঠিকই বুঝেছি।
‘বিধাতা’ আর ‘নদী’ দারুণ দুটো গল্প। বিধাতা পড়ে তো হাসতে হাসতেই খুন। এই দুই গল্পের মূলে আমার বোঝাটুকু সাংঘর্ষিক হবে বিধায় ওটি নিয়ে আর কথা না বলি।
‘সমাধান’ পড়ার পর সমাজকে আমি যতটুকু নিষ্ঠুর ভাবতাম তারচেয়েও বেশি নিষ্ঠুর মনে হয়েছে। সন্তানের মৃত্যুতে জন্মদাতা বাপ স্বস্তি পায় এ কেমন সমাজ? কিন্তু একটু উপরেই পড়ে আসা ‘তাজমহল’ কিংবা ‘গণেশ জননী’ পড়বার পর মনে হয়েছিলো জগতে এখনো ভালোবাসার অভাব বোধহয় হয়নি।
‘বিদ্যাসাগর’ গল্পটা পড়তে পড়তে একটু জন্য হাসতে হাসতে খাট থেকে পরিনি। ‘পাশাপাশি’ পড়ে বোঝা যায় তখনকার সময়েও অভাব কতোটা অস্থিমজ্জার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো।
আরও পড়ুনঃ নবান্ন নাটকের বিষয়বস্তু চরিত্র প্রেক্ষাপট | বিজন ভট্টাচার্য নাটক PDF
সেসময় বাঙালাদেশে প্রায় এককোটি মানুষ বেকার, তা লেখক কি চমকপ্রদ ভাবেই না তুলে ধরেছেন৷ পুরুষ মাত্র সব সময় নারীদের দোষ দেখেন আর নারী মাত্র দোষ খোঁজেন পুরুষদের অথচ জগতের স্বার্থ চুলোয় দিয়ে বিপরীতকে নিয়েই রাজ্যের সব টানাটানি তা ‘ছেলে মেয়ে’ গল্পে বনফুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন৷
‘চন্দ্রায়ণ’ গল্পটা মারাত্মক। এই লেখাটি না চাইতেই দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন উপায় নেই লিখতে না চাইলেও সংকল্প করে তো পিছু হটা যায় না।
অভিজ্ঞতা যে দারুণ এক জিনিস তা ‘অভিজ্ঞতা’ গল্প থেকেই বোঝা যায়৷ বাংলায় একটা লাইন আছে না “খালি কলসি বাজে বেশি” ঠিক সেরকম একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়৷ ৷
অন্যের বেলাতে যেটা কোন ধাতর্ব্যের মাঝেই পরে না তা নিজের বেলায় আসলে কিন্তু দারুণ রুপ ধারণ করে সেটি ‘আত্ম পর’ গল্প পড়েই বোঝা যায়৷ জগতে সব কিছু ফিরে ফিরে আসে৷
আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছে দেখবেন যারা কোন পাবলিক যানবাহনে উঠেই নিজেকে রাজা-বাদশা ভাবা শুরু করে। সেই সাথে আশেপাশের লোকজনকে হেয় প্রতিপন্ন করে ঠিক এদের জন্যই বোধহয় বনফুলের ‘শ্রীপতি সামন্ত’।
‘ভ্রষ্ট-লগ্ন’ – জগতের সব জিনিসই যে চিরকাল একই থাকবে একথা ভাবাও বোধহয় পাপ। আত্মগরিমায় আজ যাকে পায়ে ঠেলছি কাল ওটাকেই যে মাথায় তুলে রাখতে হবে না এমন গ্যারান্টি কি আছে?
শাজাহানের নির্মাণ “তাজমহল” আমাদের কে ভাবায় কিন্তু সহায় সম্বলহীন শাজাহানের সৌধ বা স্মৃতিচিহ্ন আমাদের ভাবাতে অসমর্থ হয় তাহার বর্ণাণা এসেছে “তাজমহল” গল্পটি থেকে।
প্রেম যে বিধ্বংসী হতে পারে “বুধনী” গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক। আমাদের সমাজে কিছু হার না মানা ব্যক্তি আছে যারা তাদের সীমাবদ্ধতা কিছু আমল না দিয়ে অধ্যবসায়, ধৈর্য্য শক্তি সর্বোপরি অদম্য ইচ্ছা দ্বারা সমাজের নিচ অবস্থান থেকে নিজেকে উচ্চ পর্যায়ে নিতে সক্ষম তাহা “অর্জুন মন্ডল” গল্প দ্বারা লেখক বর্ণণা করেছেন। গল্পটি পড়ে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। আবার গল্পটি পড়ে মনের অজান্তে হাসাও যায়। এ গল্পটি মনে বেশ দাগ কেটেছে। যদিও প্রতিটি গল্পই নিজ নিজ গুণে গুনান্বিত। তার পরে উল্লেখযোগ্য এ “অর্জুন মন্ডল” গল্পটি।
আরও পড়ুনঃ নির্বাচিত গল্প সমগ্র | আবু ইসহাক | Nirbachito Golpo Somgro | PDF
“পাঠকের মৃত্যু” গল্পটিতে প্রবল আকাঙ্কিত বস্তু কেমন করে বিরক্তিতে চলে আসে তা বর্ণিত হয়েছে “পাঠকের মৃত্যু” গল্পে।
ন’কড়ির দাদুর কেচ্ছা পড়তে পড়তে একটুর জন্য পাগল হইনি। কি গন্ডগোলে ব্যাপার। ‘যুগান্তর’ বোধহয় এমনি করেই হয়। ঠিক এমন দারুণ দারুণ সব গল্প দিয়ে সাজানো সমগ্রটি।
একটি একটি গল্প যেন এক একটি ছোট ছোট বোমা! পাঠকহৃদয়ে প্রতিটি গল্পের শেষ প্যারা দারুণভাবে আঘাত করবে। প্রতিটা গল্পের শেষে পাবেন প্রশান্তি কিংবা ফেলবেন দীর্ঘশ্বাস। ১ পাতারও ছোট্ট একটি গল্পে যে ১টা পুরো জীবনকে সার্থকভাবে তুলে ধরা যায় সেটা এই বই পড়তে গিয়ে বারেবার বুঝবেন।
বইয়ের গল্পগুলো আপনাকে শহর থেকে গ্রাম, জীবন থেকে জীবন, মানুষ থেকে অমানুষ সর্বত্র ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। সাধুভাষায় লেখা ছোট্ট লাইনের সংলাপের আবেগে ভেসেছি আমি। আমার মতো ক্ষুদ্র পাঠকের ভীষণ মন ছুঁয়ে গিয়েছে। যারা ছোট গল্প পছন্দ করেন তারা জলদি পড়ে ফেলুন।
পেশায় ডাক্তার বনফুলের সাহিত্যে বিচরণ যে ব্যর্থ নয় তার প্রমাণ তো তিনি দিয়েছেনই তার লেখায়! আফসোস হচ্ছে যে তিনি ৬৬টি উপন্যাস, ২১টি ছোটগল্পগ্রন্থ, ৮টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি নাটক, ১০টি প্রবন্ধ, রম্যরচনা এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন কিন্তু আমার একটাও পড়া হয়নি!
শ্রেষ্ঠ গল্প সমগ্র টিতে মীর হুমায়ূন কবীরের লেখা ভূমিকার অংশটি পড়েও অনেক কিছু জানতে পারবেন। বইটির শেষে বলাইচাঁদের সম্পর্কেও পাবেন কিছুকথা।
আরও পড়ুনঃ গল্পগুচ্ছ Read Online | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | Golpo Guccho PDF