যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
ছ. মৃত্যু চিন্তাঃ
মৃত্যু কামনায় সুকান্ত রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হয়েছেন কোথাও কোথাও। মৃত্যুর জন্য সুকান্তর এ আকুতি সম্ভবত নিম্নোক্ত কবিতাংশ পাঠ করেই এসেছিল ।
“সারা জনম তোমার লাগি,
প্রতিদিন যে আছি জাগি,
তোমার তরে বহে বেড়াই
দুঃখ সুখের ব্যথা।”
সুকান্তর ব্যক্তিগত জীবনে কেবলই মরণের আধিক্য। রাণীদি নেই, মা নেই, জ্যাঠাম’শয় নেই; এমনকি আর কিছুদিন পর তিনিও বিদায় নিলেন। তবু এই মরণের মাঝে সুকান্ত রেখে গেছেন এক অমর জীবনের জয়গান।
সুকান্তর মৃত্যুকে সুকান্ত নিজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। হৃদস্পন্দন থেমে আসার সংবাদ অনুভব করেছিলেন নিজেই। তাঁর রচনায়ও সে ঘাতক মৃত্যুর কথা বাদ পড়েনি। তাই তাঁর মনে প্রশ্ন,
“দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?”
অবৈধ কবিতায় বলেছেন,
“সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা ।
সেই দিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত।”
‘হে পৃথিবী’ কবিতায় সুকান্ত আমাদের পূর্বাভাস দিয়েছেন-
‘হে পৃথিবী, আজিকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায়,
যদি কভু শুধু, ভুল করে
মনে রাখো মোরে,
বিলুপ্তি সার্থক মনে হবে
দুর্ভাগার।…
প্রভাত পাখির কলস্বরে
যে লগ্নে করেছি অভিযান,
আজ তার তিক্ত অবসান ।”
‘সহসা’ কবিতায় সুকান্ত লিখেছেন,
‘আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী, এ পারে মর্মরধ্বনি-তান, নিস্পন্দ শরের রাজ্য হতে ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।/গোধূলি আকাশ বলে দিল,/তোমার মরণ অতি কাছে,”/
‘সুতরাং’ কবিতায় ও মৃত্যুর হাতছানি পরিলক্ষিত হয়ঃ
“এতদিন ছিল বাঁধা সড়ক,
আজ চোখে দেখি শুধু মরক!
এত আঘাত কি সইবে,
যদি না বাঁচি দৈবে?”
কেননা (‘বুদ্বুদমাত্র’ কবিতায় সুকান্ত বলেন)-
“জন্মের প্রথম কাল হতে,
আমরা বুদ্বুদমাত্র জীবনের স্রোতে।”
“আমার মৃত্যুর পর” কবিতায় মৃত্যু সম্পর্কে সুকান্ত যে মত ব্যক্ত করেছেন তা হল-
“আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,
……
আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর/লাঞ্ছনার বেদনায়,
স্পষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।”
‘মুহূর্ত’ কবিতায় সুকান্ত বলেন, “মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা; যে মুহূর্ত/তোমার আমার অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা, ‘মরণের তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’-পূর্বসূরির এই তত্ত্ব নিয়ে সুকান্ত একটি গান রচনা করেছিলেন, যেখানে মৃত্যুকে তিনি বরণ করে নিয়েছেন। মরণকে বলছেন, ‘নিরব চুমি করিও হরণ’। এখানে এসে যেন সুকান্তর সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ ঘটেছিল ।
“হে মোর মরণ, হে মোর মরণ।
বিদায় বেলা আজকে একেলা দাওগো শরণ!
…
তোমার বুকে অজানা স্বাদ,
ক্লান্তি আনো, দাও অবসাদ;
তোমায় আমি দিবস যামী করিনু বরণ ॥
আমায় তুমি নিরব চুমি করি ও হরণ।”
ক্লান্ত কবি আর পারদুন না জীবনের ভার বইতে। তিনি মুক্তি চেয়ে বলেছেন, “ক্লান্ত আমি আমি কর ক্ষমা; মুক্তি দাও হে এ মরু মরুরে, প্রিয়তমা।
” কবি যে ঝরে যাবেন তা তাঁর অন্তর জেনেছিল। জেনেছিল বলেই তাঁর এত কাজ, এত তাড়া। সব কিছু বুঝেই যেন সুকান্তর উচ্চারণ,
“আজ মোর ঝরিবার পালা,
সব মধু হয়ে গেছে ঢালা;
আজ মোরে চলে যেও দিল।”শেষ মিনতি (গান)-তে কবি বলেন,
“আমি কেঁদে কই যেওনা কোথাও
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও”
আয়োজন (বর্ণনা)-এ দেখা যায় কবি মৃত্যুকে চিরন্তন সত্য এবং শাশ্বতের সুর বলে আখ্যায়িত করেছেন আবহমানকালের সুর বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
… ‘বিশ্ব বীণার তারে আজ কোন সুর বেছে উঠেছে, জানো? সে তোমারই বিদায়-বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর।’ ‘যাত্রা’ (আবৃত্তি)য় মৃত্যুর জন্য সুকান্তকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যায়- ‘অমৃত লোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন প্রস্থানের পথে তোমার একাকী অভিযান। প্রতিদিন তাই/নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য আশঙ্কায়’,
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।” বিশ্বকবির এই বাণী সুকান্ত যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে ‘বিদায়’ (গান)তে বলছেন,
“বিদায় নিতে চায় কে ওরে
বাঁধরে তারে বজ্র ডোরে’
সুকান্ত যেন মৃত্যুপথ যাত্রী হরিণী, রাখাল ছেলেকে বলছে,
“বাঁশি তোমার বাজাও বন্ধু আমার মরণকালে,
মরণ আমার আসুক আজি বাঁশির তালে তালে।”
আবার যেন হরিণীকে হারিয়ে রাখাল ছেলেরূপী সুকান্ত গাইছেন-
‘বিদায় দাওগো, বণের পাখী!
বিদায় নদীর ধার,
…/…
আর কখনো হেথায় আসি
বাজাবন এমন বাঁশি’
আবার যেন বলছে ‘ডেকো না গো তোমরা আমার চলে যাবার বেলা’,
মরণের ইঙ্গিত শুধু কবিতা বা গানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি সুকান্ত। তাঁর কাজে, আচার-ব্যবহারে এবং চিঠি পত্রের জবানীতেও সেই ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ আবু ইসহাকের গল্প : ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ | ১ | আহমাদ মোস্তফা কামাল
তথ্যসূত্রঃ
১. ১৩৫৪ সালের ‘পরিচয় শারদীয়'তে শ্রীযুক্ত জগদীশ ভট্টাচার্য কর্তৃক লিখিত কবি কিশোর নামক প্রবন্ধের অংশবিশেষ।
২. বদরুদ্দীন উমর, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৭৭, ঢাকা।
৩. বন্ধু অরুণাচলকে লেখা সুকান্তের দীর্ঘতম এক ঐতিহাসিক চিঠির অংশবিশেষ।
৪. মার্কসীয় অর্থনীতির মূল সূত্র : এল. লিয়ন তিয়েভ।
৫. সাহিত্য চর্চা, বুদ্ধদেব বসু ।
৬. রবি রশ্মি। চারু চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ.।
৭. বাংলা সাহিত্যের খসড়া। শ্রী প্রিয় রঞ্জন সেন।
৮. সুকান্ত কবি ও মানুষ। সামাদ সিকদার। (ভূমিকার ক্ষেত্রে সামাদ সিকদারের সুকান্ত কবি ও মানুষ বইটি অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। সামাদ সিকদারের কাছে ঋণ স্বীকার করছি।)