যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বইঃ হাজার বছর ধরে
লেখকঃ জহির রায়হান
“রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সেই রাত…”
উপন্যাসের শেষ লাইন ছিলো এটি। উক্তিটির তাৎপর্য ছোটবেলায় উপলব্ধি করতে পারিনি কিন্তু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি উক্তিটি দিয়ে লেখক কি বুঝিয়েছিলেন। এই একটামাত্র বাক্যে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন গ্রাম বাংলার চিত্র হাজার বছর ধরে একই রয়ে গেছে। নবাব, জমিদার, ইংরেজ এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্থান শাসনেও গ্রাম-বাংলার কোন পরিবর্তন হয়নি।
আমাদের জীবনযাপনের জীবনধারা নিয়ে হাজার বছর ধরে উপন্যাসের লেখক জহির রায়হান দেখিয়েছেন প্রতিটি বংশের গোরাপত্তন কিভাবে হয়, আর কিভাবে সেই বংশের ধারা বয়ে চলে। প্রতিটি বংশের একজন চালক থাকে। সময়ের পরিক্রমায় তা পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো তা ছোট হতে হতে বংশ থেকে পরিবার হয়। তবে চালকের যে ধারা তা পরিবর্তন হয় না।
হাজার বছর ধরে চলে আসা বাংলার এই বংশ পরিক্রমা নিয়েই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার জহির রায়হানের কালজয়ী সৃষ্টি হাজার বছর ধরে উপন্যাস। নামকরণের সার্থকতা বিচারে বলা যায় উপন্যাসটি নামকরণে একদম সার্থক। শিরোনামে শতভাগ বিষয়বস্তু ফুটে উঠেছে। হাজার বছর ধরে চলমান গ্রাম বাংলার চিরায়চরিত চিত্র যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক জহির রায়হান। জনপ্রিয় এই উপন্যাস থেকে ২০০৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মান করেন তারই সহধর্মিনী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা।
আরও পড়ুনঃ আরেক ফাল্গুন PDF | রিভিউ | জহির রায়হান | Arek Falgun Book Review
হাজার বছর ধরে উপন্যাসটি যে আমি কতবার পড়েছি তার কোনো হিসাব নেই। আর সিনেমাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি বার দেখা সিনেমা। এখনো বারবার দেখি, হয়তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দেখতে মন চাইবে। তবুও গল্পটি চিরসবুজই মনে হবে। কেননা “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসের সাথে আমাদের প্রজন্মের আবেগ জড়িত।
আমাদের পাঠ্য বইয়ের উপন্যাসের তালিকায় ছিলো, পাঠ্য বই পড়ার বাহানা নিয়ে শুধু এই উপন্যাসটি পড়তাম। যতবারই পড়তাম ততবারই মুগ্ধ হয়েছি, খুবই ভালো লেগেছে। সে ভালো লাগা মনের তৃপ্তিতে পরিনত হয়েছিল। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার উৎকৃষ্ট উদাহরণ জহির রায়হান এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন উপন্যাসটি পড়লেই মনে হতো ফিরে গিয়েছি সেই গ্রামীণ জীবনে। যেন এটা আমার নিজেরই গল্প। গ্রামীণ জীবন, কুসংস্কার, জরা রোগ, মৃত্যু, পরম্পরা, সংস্কার সবকিছু উঠে এসেছে এই উপন্যাসটিতে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
অজগর সাপের মতো এগিয়ে চলা মেঠো পথের বর্ণনা দিতে দিতে গল্পের শুরু। তারপর পরীদিঘির গল্প, কাশেম সিকদারের বংশের গোরাপত্তন। কালের পরিক্রমায় কাশেম শিকদার মাটিতে মিশে যায় এবং তাঁর উত্তরসূরি মকবুল এবং শিকদার বাড়ির মানুষজনকে নিয়ে মূলত কাহিনী আবর্তিত হয়।
শিকদার বাড়ির বর্তমান কর্তা মকবুল। তিনখানা বৌ তাঁর। আমেনা বিবি, ফাতেমা বিবি এবং টুনি বিবি। ছোট বৌ টুনি বিবি গল্পের নায়িকা। কিছুটা চঞ্চল ও ছেলেমানুষি টাইপের স্বভাব তাঁর। কতই বা বয়স হবে, বারো কি তেরো। বয়সে সে মকবুলের বড় মেয়ে হিরণের সমান। মকবুলের শাসন মানতে চায়না সে, পাখির মত উড়ে বেড়াতে চায়।
আরও পড়ুনঃ হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির লেখক কে? সম্পূর্ণ কবিতার আসল রচয়িতা কে?
গল্পের নায়ক মন্তু মিয়া মকবুলের চাচাতো ভাই হয়। ছোটবেলায় বাপ-মা মরার পর থেকে মকবুলের সংসারেই থাকে। আয় রোজগার যা হয় এই সংসারেই দেয়। সম্পর্কে টুনি ভাবি হলেও সে ভাবি বলে ডাকে না। তাঁর সাথে অন্যরকম একটা সম্পর্ক আছে। যে সম্পর্কের কোন সংজ্ঞা নাই। পরিণতি কি হবে তাও জানে না। ধল প্রহরে একসাথে শাপলা তোলে তারা। নৌকায় চরে ঘুরে বেড়ায়। রাতে চুরি করে মাছ ধরে। হাসিঠাট্টা করে। শীতের সময় খেজুরের রস চুরি করে। এসব কাজে তারা খুব মজা পায়।
অন্যদিকে মা মরা মেয়ে আম্বিয়া। মায়াবী চোখদুটোর সাথে অসম্ভব সুন্দর চেহারা তাঁর। রাতে ঢেঁকিতে চড়ে সুরে সুরে ধান বানে। জীবিকার কাজে প্রায়ই আম্বিয়াদের বাড়িতে যায় মন্তু মিয়া। মন্তুকে দেখলেই কি যেন হয়ে যায় ষোড়শী মেয়ে আম্বিয়ার। মন্তু মিয়াও আম্বিয়া থেকে চোখ ফেরাতে পারেনা। নৌকা বাইতে বাইতে উদাস মনে গেয়ে উঠে…
আশা ছিলো মনে মনে,
প্রেম করিবো তোমার সনে…
তোমায় নিয়া, ঘর বান্ধিমু
গহিন বালুর চরে গো,
গহিন বালুর চরে…
কারে নিয়া ঘর বাঁধতে চায় মন্তু? আম্বিয়াকে? নাকি টুনি?
আরও পড়ুনঃ এইসব দিনরাত্রি হুমায়ুন আহমেদ উপন্যাস রিভিউ | Eisob Dinratri Book PDF
এ তো গেলো গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের বর্ণনা। কিন্তু উপন্যাসটি শুধু এদেরকে কেন্দ্র করেই নয়। শিকদার বাড়ির অন্য সকল মানুষজনকে নিয়ে সুখে দুঃখে গল্প এগুতে থাকে। গ্রামের মানুষজন ক্ষেতে লাঙ্গল চালায়, রাতে সবাই একসাথে পুঁথিপাঠ শুনে, আবুইল্লা বৌ পিটায়, ফকিরের মা, সালেহা প্রতিবেশীর ভূমিকায় থাকে, মন্তু এবং টুনি শান্তির হাটে যাত্রা দেখে, চুড়ি কেনে, একসময় গ্রামে মহামারী কলেরা আঘাত হানে। সবাই মিলে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এ যেন একটা জীবনধারার সম্পূর্ণ প্রতফলন।
পুরো একটা গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি পাবেন এই উপন্যাসটিতে। গ্রামে আপনার বেড়ে উঠা না হলেও, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন প্রতিটি মুহূর্ত। তাই আর দেরি না করে এখনি পড়ে ফেলুন জহির রায়হানের এই কালজয়ী উপন্যাসটি।
আসলে এই উপন্যাস রিভিউ দিয়ে শেষ করা যায়না। অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। পুরো উপন্যাসটা পড়ে শেষ করলেও এর রেশ থেকে যাবে অনেকদিন, হয়তো আজীবন। হৃদয়ের মণিকোঠায় সারাজীবনের জন্য গেঁথে যাবে মন্তু মিয়া আর টুনির গল্পটি। বারবার পড়ার আগ্রহ জন্মাবে আর একরাশ আফসোস তৈরি হবে। মনে মনে বলবেন, কেন শেষ হয়ে গেলো? জীবনধারা তো শেষ হবার নয়। আর কি বড় করা যেতো না? পরবর্তীতে কি হয়েছিলো?
আরও পড়ুনঃ পুতুল নাচের ইতিকথা রিভিউ PDF | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস সমালোচনা
হাজার বছর ধরে সিনেমা
এবার আসি সিনেমার কথায়। জহির রায়হানের সহধর্মিণী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা গল্পটিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন। চাচাতো ভাই রিয়াজকে নিয়েছেন মন্তু মিয়ার চরিত্রে। পুরো পরিবারটি চিত্রজগতের মানুষ, তাই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই সবাই যত্নের সাথে কাজটি করার চেষ্টা করেছেন।
বইটা পড়ে কল্পনায় যে মন্তুকে চিন্তা করেছি রিয়াজ সেই চরিত্রে শতভাগ পারফেক্ট ছিলো। এই চরিত্রে অন্য কাউকে কল্পনাই করতে পারিনা। আর চঞ্চল কিশোরী হিসেবে নবাগতা শশী ছিলো অনবদ্য। মায়াবী চেহারা আর মনোমুগ্ধকর হাসি সত্যি কল্পনার টুনিকেই উপস্থাপন করেছে।
মকবুলের চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান ছিলো দুর্দান্ত। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রগুলোতে সকলেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে। সবমিলিয়ে সকলের অভিনয় দেখে এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয়নি যে আমি কোনও সিনেমা দেখছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে আমার সামনে ভেসে উঠছে আমার জীবনেরই একটা গল্প। গ্রামে বেড়ে উঠা সকলের কাছে এটাই মনে হবে।
আরও পড়ুনঃ ভোকাবুলারি শেখার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী ১০টি উপায়
সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিলো শ্রুতিমধুর গানগুলো। সুবীর নন্দী ও অনুপমা মুক্তির কন্ঠে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা “তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, নাকি তোমার মন…” গানের লিরিক আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। বর্ষায় গ্রামে গেলে এই গানটা হয়ে যায় আমার নিত্য সঙ্গী।
তারপর জহির রায়হানের লেখা “আশা ছিল মনে মনে…” গানটা তো উপন্যাসটা পড়ার সময় থেকেই ভালোলাগা শুরু হয়। অন্যদিকে কিংবদন্তী এন্ড্রো কিশোরের কন্ঠে “এই দুনিয়া দুই দিনেরই মুসাফির খানা… ও ভাইরে…” গানটি আপনাকে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যাবে। গানের চমৎকার প্রয়োগ হয়েছিলো এই সিনেমাটায়।
হাজার বছর ধরে সিনেমাটি ২০০৫ সালে ৮ জুলাই ছবিটি মুক্তি পায় এবং এনটিভি-তে প্রচারিত হয়। তারপর বেশ কয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। পরিচালক কোহিনুর আক্তার সুচন্দা ডেইলি স্টারের এক ইন্টারভিউতে জানান, সিনেমাটিতে অভিনয়ের জন্য অভিনেতা রিয়াজ মাত্র ১০১ টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনঃ শেষ বিকেলের মেয়ে উপন্যাস রিভিউ PDF | জহির রায়হান