যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বুক রিভিউ – আমার ফাঁসি চাই
রিভিউ করেছে- Jahirul Islam
বইটার নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল, শেখ হাসিনা ও আমার ফাসি চাই, কিংবা শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব( মরনোত্তর) ও আমার ফাসি চাই। কিন্ত সেটা না লিখে বইয়ের টাইটেল রেখেছে শুধুমাত্র ‘আমার ফাসি চাই’।
বইয়ের বিষয়বস্তু আলোচনার আগে লেখকের পরিচয় একটু ভালভাবে জানা দরকার। মতিউর রহমান ৭১ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এবং ৭৫ সালে প্রতিরোধ যুদ্ধও করেছেন।( শেখ মুজিবের খুনের পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটা দল ভারতে পালিয়ে গিয়ে সংগঠিত হয়, এবং ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে এলাকা দখল করতে থাকে। তাদের টার্গেট ছিল, এভাবে একটা একটা করে গ্রাম দখল করে, বা পুলিশ ফাড়ি দখল করতে করতে আস্তে আস্তে ঢাকা পর্যন্ত দখল করে গিয়ে তারপর বঙ্গবন্ধুর বদলে যে সরকার ঢাকায় বসে আছে তাকে উতখাত করতে হবে। এই যুদ্ধটাকেই প্রতিরোধ যুদ্ধ বলে।
তবে বছরখানেক পরে এই ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ মিইয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে মতিউর রহমান রেন্টু টাঙ্গাইলের একটা গ্রামে আত্মসমর্পণ করেন । তাদের হাতে তখন বন্দুক ছিল,কিন্তু গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল)।
এরপর স্বল্প সময়ের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। ৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশের ফেরার পর থেকে তার এক ধরনের সেক্রেটারি /এ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজ করেছেন রেন্টু । তার স্ত্রী, ময়না রহমান ও কাজ করেছে শেখ হাসিনার সাথে। ময়নার রেগুলার দায়িত্ব ছিল, রাতে ঘুমানোর আগে শেখ হাসিনার শরীর ম্যাসাজ করে তাকে ঘুম পাড়ানো, এবং তার খাওয়া দাওয়া মনিটরিং করা। মতিউর রহমান রেন্টুর দায়িত্ব টা ঠিক ক্লিয়ার না। সম্ভবত সিকিউরিটি গার্ড/বডিগার্ড এর মত দায়িত্ব পালন করতেন। কয়েকবার তাকে দেখা গিয়েছে, মোটরসাইকেলে করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পাশে থেকে গোয়েন্দা হিসেবে খবর সংগ্রহ করে দ্রুত শেখ হাসিনার কাছে পৌছে দেওয়া। একবার তাকে দায়িত্ব দেওয়া হল , রেগুলার শেয়ার বাজারে ভীড় কেমন হচ্ছে সেইটা মনিটর করা। তবে কাগজপত্র লেখালেখি টাইপ কাজ সম্ভবত তার এখতিয়ারে ছিলনা। রেন্টুর লেখায় বানান ভুল আছে প্রচুর। বিশেষত, ইংরেজি শব্দগুলো বাংলায় বেশ অদ্ভূত উপয়ে লিখেছেন তিনি।
একটা সময়ে শেখ হাসিনা মতিউর রহমান রেন্টুকে প্রমিজ করেছিলেন, ১৯৯৬ ইলেকশনে রেন্টুকে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী আসনে এমপি পদে মনোনয়ন দিবেন। কিন্তু ইলেকশনের সময় সেই মনোনয়ন আর দেন নি। ফলে রেন্টু বেশ মনো:ক্ষুন্ন হয়েছিল। পরবর্তীতে, বিএনপি তাকে ইলেকশনে মনোনয়ন এর লোভ দেখিয়েছিল কিনা, বা অন্য কোনো সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দিয়েছিল কিনা, সেটা জানায়নি। তবে পুরো বইতে বিএনপি/খালেদা জিয়ার কোনো বদমাম করা হয়নি। লেখকের দাবি অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে একটা রাজনৈতিক টপিকে লেখক শেখ হাসিনাকে তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটা ভিন্ন সাজেশন দিলে, শেখ হাসিনা তাকে আর তার বউকে চাকরি থেকে ছাটাই করে দেন। এরপর সম্ভবত তারা দেশত্যাগ করে। ২০০৭ সালে ফ্রান্সে মতিউর রহমান রেন্টুর মৃত্যুর খবর পাচ্ছি কিছু অনলাইন পত্রকায়।
যেহেতু রেন্টু সাহেব শেখ হাসিনার পাশে দীর্ঘসময় থেকেছেন, তার চোখে যা যা ধরা পড়েছে, সেগুলা তিনি এই বইতে তুলে এনেছেন। এর অধিকাংশ তথ্য অন্য কোনো বইয়ে, বা কারো ইন্টারভিউ তে পাওয়া যায়না, কেবল রেন্টুর বইতেই পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ আমি মেজর ডালিম বলছি – শরিফুল হক ডালিম
এমন কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য হল –
১. ময়না যখন শেখ হাসিনাকে ম্যাসাজ করত, তখন মাঝে মাঝে শেখ হাসিনা বলত, আমার স্বামী ( ওয়াজেদ মিয়া) আমাকে অনেক মারতো, আমার শরীরে অনেক ব্যথা। মারধরের কারন অবশ্য বলেনি।
১৯৮১ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত (এই বই লেখা পর্যন্ত) শেখ হাসিনাকে কখনো ওয়াজেদ মিয়ার সাথে রাত কাটাতে দেখা যায়নি। এমনকি , তারা কখনোই একই ছাদের নিচেও বাস করেননি। আলাদা আলাদা থাকতেন।
২. ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের এক ছাত্র নেতা ( নাম মৃনাল কান্তি ভৌমিক) এর সাথে শেখ হাসিনার এক ধরনের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল ১৯৮৫-১৯৯০ সালের দিকে। ১৯৪৮ এ হাসিনার জন্ম ধরলে, তখন তার বয়স ৪০ এর আশেপাশে। রেন্টুর বর্ননা অনুযায়ী, একটা পর্যায়ে এই ছেলেই শেখ হাসিনাকে অবহেলা করা শুরু করে, বা টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নেয়। এরপরে শেখ হাসিনাও তার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। ৯১ এর পরে এই ছেলেকে আর তেমন দেখা যায়নি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, ১৯৯৬ সালেও একবার এই ছেলে গণভবনে এসেছিল। শেখ হাসিনা তাকে বেইল দেয়নাই।
৩. ১৯৮১ সালে আর্মির একটা অংশ জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ক্যু করবে – এই খবর শেখ হাসিনার কাছে এসেছিল। তিনি এক্স মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গ্রুপকে রেডি করলেন, যারা ক্যু এর পরে গ্যাঞ্জামের সুযোগ নিয়ে নিজেরাও একটা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে ( এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করবে)। তবে সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয়নি। জেনারেল মঞ্জুর জিয়াউর রহমানকে খুন করল ঠিকই, কিন্তু সেনাবাহিনীতে তার অনুগত লোক ছিল কম। এরশাদের আদেশে সেনাবাহিনীর বাকি অংশ জেনারেল মঞ্জুরের দলবলকে এ্যারেস্ট করে ফেলল। আওয়ামী লীগ ঘরানার যোদ্ধারা আর কিছু করতে পারল না।
৪. ১৯৮৩ সালে একটা ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা চেয়েছিল কিছু লাশ। লাশ পেলে আন্দোলন চাঙা হয়। এ কারনে, কিছু ছাত্রনেতাকে টাকা দিয়ে রাজি করিয়েছিলেন,তারা যেন মিছিল নিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসের বাইরে যায়। ( ক্যাম্পাসের ভেতরের মিছিলে ইউজুয়ালি পুলিশ গুলি করেনা) এরপর, পুলিশদের মধ্যেও কয়েকজনকে টাকা দিলেন, তারা যেন আবু সাইদ স্টাইলে ছাত্রদের উপর গুলি করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ছাত্রদের একটা মিছিল ক্যাম্পাসের বাইরে বের হলে পুলিশ গুলি চালাল। নিহত হল জয়নাল, দীপালী, কাঞ্চন সহ কয়েকজন ছাত্র। ছাত্রনেতারা সব কিছু জানত, তারা মিছিলের সামনে ছিল না, যেন তাদের গায়ে গুলি না লাগে।
আরও পড়ুনঃ যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি – শরিফুল হক ডালিম
ঘটনার পর শেখ হাসিনা কিছুটা ছোটাছুটি করলেন, কিন্তু কোনো কঠোর আন্দোলন দিলেন না। রেন্টুর সন্দেহ, এখানে শেখ হাসিনা সম্ভবত এরশাদের কাছ থেকে বিপুল টাকা পেয়ে চুপ করে ছিলেন, আন্দোলন দেননি।
( এই ঘটনার স্মরণে অনেকে ১৪ইন ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করতে নিরুতসাহিত করেন)
৫. ১৯৮৪ সালে অনুরুপ এক ঘটনায় ক্যাম্পাসের বাইরে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পরে পুলিশের একটা গাড়ি পেছন থেকে মিছিলে তুলে দিয়েছিল। এবারেও ছাত্রনেতাদের কাছে আগাম খবর ছিল। এবার তারা মিছিলের পেছনে কেউ থাকেননি।
৬. ১৯৮৬ সালে এরশাদ একটা ডামি ইলেকশন করতেছিল। বিএনপি সহ সব দল সেই ইলেকশন বয়কট করেছিল। আওয়ামী লীগ ও প্রথমে বয়কটের কথা বলেছিল। এরপর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফয়াই ধানমন্ডি ৩২ এর অফিসে এসে গাড়িভর্তি কয়েক বস্তা টাকা অফিসে তুলে দিল। এই টাকা পাওয়ার পর শেখ হাসিনা ঘোষনা দিল, আমরা নির্বাচনে অংশ নিব।
রেন্টুর অনুমান, নির্বাচনের আগে ১০ কোটি (৯ বস্তা) এবং পরে ১৫ কোটি (১৩ বস্তা), মোট ২৫ কোটি টাকা এ সময় ডিজিএফআই দিয়েছিল।
৭. ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলেন। শেখ হাসিনার দলীয় আদর্শের সাথে জাহানারা ইমামের আন্দোলনটা মেলে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে শেখ হাসিনা জাহানারা ইমামকে পছন্দ করতেন না। তাই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘাদানিক (ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি) এর প্রগ্রামে মাঝে মাঝে যেতেন, কিন্তু নিজের দলের নেতাকর্মীদের আদেশ দিয়েছিলেন, তোমরা এখানে যাবে না।
আরও পড়ুনঃ ইহুদি জাতির ইতিহাস PDF Download | আবদুল্লাহ ইবনে মাহমুদ
রেন্টুর কাছে একদিন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভারতের ‘র’ চাচ্ছে, আমাকে সরিয়ে দিয়ে জাহানারা ইমামকে আওয়ামী লীগের নেত্রী বানাবে।
৮. ৯১-৯৬ এ বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মিছিল মিটিং এ একদল গুন্ডা/স্নাইপার ভাড়া করতেন। এরা সভা সমাবেশের আশেপাশে নিরীহ পথচারীদের গুলি করে মেরে ফেলত। মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শেখ হাসিনা তখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো জোরালো হরতালের কর্মসূচি দিত। রেন্টুর অনুমান, এই ৫ বছরে শ’খানেক নিরীহ লোক এভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
৯. শেখ হাসিনা নিয়মিত ফেন্সিডিল খেতেন। মূলত, বক্তব্য দেওয়ার সময় গলা ঠিক রাখার জন্য এটা খাওয়া শুরু করলেও পরে এটা রেগুলার অভ্যাস হয়ে যায়। একটা সময়, তার ভাষনের স্টেজেও সহকারীরা ফেন্সিডিল যুক্ত চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
১০. একটা দুর্গম এলাকায় ( ফরিদপুরের আশেপাশে) নির্বাচনী সফরে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, এখানে আসার জন্য নৌকা ছাড়া কোনো পথ নেই। তখন তিনি নিজে ঐ নৌকায় করেই পার হলেন। ফেরার পথে এলাকার মাঝিদের ৫০ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি এবং ৫০০০ টাকা নগদ দিয়ে বললেন, খালেদা জিয়া এই পথে এলে তার নৌকা ডুবিয়ে দিও।
১১. ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা আর্মি চিফকে কু করতে উতসাহিত করেন। আর্মি চিফ, মোহাম্মদ নাসিম এর হাতে আর্মির পুরো অংশের নিয়ন্ত্রন ছিলনা। তারপরেও নাসিম তার দলবল নিয়ে কু করল । সেনাবাহিনীর বাকি অংশ দেশের প্রেসিডেন্টের আদেশ মেনে আর্মি চিফ জেনারেল নাসিমের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরল। আর্মি চিফ এ্যারেস্টেড হলেন। হাসিনা কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। রেন্টুর কাছে বললেন, আমি আরো ৬ মাস আগেই ওকে কু করতে বলেছিলাম, আমার কথা তখন শোনেনাই, এখন মজা বুঝুক।
১২. শেখ হাসিনা খুলনা থেকে দিনাজপুর দীর্ঘ একটা ট্রেন জার্নি করেছিলেন ইলেকশনের আগে। সেখানে প্রতি স্টেশনে থেমে থেমে জনসভা করেছিলেন।।রাতে ঈশ্বরদী স্টেশনে পৌছে তিনি নিজেই গোলাগুলি করার আদেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল, শেখ হাসিনার উপরে হামলা।
১৩. ঢাকার মেয়র হানিফ সহ অনেককে মন্ত্রীত্ব দেওয়ার মত প্রলোভন দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত দেননি।
১৪. ৯৬ এ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বিদেশ থেকে শেখ রেহানা উড়ে এসে ক্ষমতার ভাগ চায়। হাসিনা তখন তাকে আর্থিক কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে থামিয়ে রাখে।
আরও পড়ুনঃ আমি পদ্মজা ইলমা বেহরোজ উপন্যাস PDF | Ami Padmaja Uponnash
এইরকম আরো অনেক টুকরো ঘটনা পাওয়া যায় বইতে। এসব ঘটনার সত্যমিথ্যার ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। যেহেতু এইসকল অপরাধমূলক কাজে মতিউর রহমান রেন্টুও জড়িত ছিল, তাই রেন্টুও নিজের ফাসি চেয়েছে। তবে তাকে ফাসি দেওয়ার আগে শেখ হাসিনাকে ফাসি দেওয়ার দাবিও করেছে।
ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে বইটা না পড়লেও, কমেডি হিসেবে পড়তে পারেন। কেউ যদি এই বইকে স্ক্রিপ্ট ধরে সিনেমা/সিরিয়াল বানায়, তাইলে ‘আলাদিন’ সিনেমাটাকে খুব সহজেই টেক্কা দিবে।