যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
মুজিব: একটি জাতির রূপকার | Mujib: The Making of a Nation
রিভিউ লেখকঃ আখতারুজ্জামান আজাদ
ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বায়োপিক নির্মাণ অত্যন্ত দুষ্কর। এত-এত ঘটন-অঘটন দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে দেখিয়ে ফেলা অসম্ভব। ফলে, এ ধরনের বায়োপিক দেখে খাপছাড়া লাগে, ঘটনাপ্রবাহ বাপছাড়া লাগে, ফিরতে হয় হতাশ হয়ে। ‘মুজিব’ চলচ্চিত্র দেখে অবশ্য শতভাগ হতাশ না। আট-দশ শতাংশ মুগ্ধ হয়েছি। এই চলচ্চিত্রে সোহরাওয়ার্দির চরিত্র তৌকির আহমেদ, ভাসানির চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ নিরানব্বই শতাংশ নিখুঁত অভিনয় করেছেন। স্বল্প সময়ের উপস্থিতি থাকলেও উতরে গেছেন শেখ লুৎফর রহমান চরিত্রে খায়রুল আলম সবুজ, খন্দকার মোশতাক চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, একে ফজলুল হক চরিত্রে শহিদুল আলম সাচ্চু, মানিক মিয়া চরিত্রে তুষার খান। তাদের উতরানোরই কথা। কারণ তারা অভিনয়ে উঠে এসেছেন মঞ্চ থেকে।
মানিক মিয়া ছিলেন বরিশাইল্লা, তুষারও এখানে সুন্দরভাবে বরিশাইল্লা ভাষায় কথা বলেছেন। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো নিয়ে বায়োপিক হলে তাতে মঞ্চাভিনেতাদেরই অভিনয় করা উচিত। গান্ধী, জিন্নাহ, ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান, অশোক তারা— এসব চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন, তাদের নাম জানি না। কিন্তু তাদেরকে দেখে মনে হয়েছে চরিত্রগুলো তাদের জন্যই তৈরি, তারা চরিত্রগুলোর জন্যই তৈরি। শেখ ফজলুল হক মণি, শেখ নাসের, ওয়াজেদ মিয়া, তোফায়েল আহমেদ, জিয়াউর রহমান— এই চরিত্রগুলোও বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এক শব্দের সংলাপ নিয়ে পর্দায় দুই সেকেন্ডের জন্য সুযোগ পেয়ে টিক্কা খান চরিত্রে এমনকি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঃখ’ জায়েদ খানও মন্দ করেননি। চলনসই ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাহের ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, শেখ কামাল, শেখ জামাল চরিত্রের অভিনেতারাও। কোনো সংলাপ না থাকলেও খলিলুর রহমান কাদেরিকে এম মনসুর আলীর মতোই লেগেছে।
আরও পড়ুনঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী রিভিউ PDF | সারমর্ম সংক্ষেপ
চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটিয়েছেন তাজউদ্দিন চরিত্রে রিয়াজ। রূপসজ্জাকারীরা চেপেচুপে, টিপেটুপে, ঠেলেঠুলে তাজউদ্দিন বানিয়ে ছাড়লেও রিয়াজ কণ্ঠে ধরা খেয়ে গেছেন। এই ন্যাক্কারজনক নিব্বি-কণ্ঠ নিয়ে তাজউদ্দিন হওয়া যায় না। তার চেহারায়ও ছিল স্পষ্ট স্নায়বিক দৌর্বল্য, ছিলেন ঘেমে একাকার। মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধের মতো মেয়াদোত্তীর্ণ অভিনেতাও দর্শকস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রিয়াজ মেয়াদোত্তীর্ণ অভিনেতা। গোটা ক্যারিয়ারে রিয়াজের অভিনয় সবচেয়ে ভালো হয়েছিল শিল্পীসমিতির নির্বাচনের প্রাক্কালে সমবেত ক্রন্দনদৃশ্যে।
দ্বিতীয় বিপর্যয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা। ফজিলাতুন্নেছা চরিত্রের বুদ্ধিমত্তা, ঐতিহাসিক ওজন, আকণ্ঠ আবেগ বহন করা তিশার কাজ না। তিশার কাজ মোশাররফ করিমের সাথে বিবদমান মারজুক রাসেলকে বা মোশাররফ করিমের সাথে বিবদমান তপুকে সামলানো। তিনি করিমের নায়িকা হিশেবে মুখমণ্ডলে যে বঙ্কিম অভিব্যক্তি দেখিয়ে থাকেন, ফজিলাতুন্নেছা চরিত্রেও তা-ই দেখিয়েছেন। পাঁচ বাচ্চার মায়ের চরিত্রে তিশাকে যারা নির্বাচন করেছেন, তাদের উদ্দেশে কিছু বলার নেই। শেখ হাসিনার চরিত্র করেছেন নুসরাত ফারিয়া। অর্থাৎ তিশার পাঁচ বাচ্চার এক বাচ্চা নুসরাত ফারিয়া! ফারিয়া তিশাকে মা-মা বলে ডাকছেন— পর্দায় এই অলৌকিক দৃশ্যটা দেখে বিমোহিত না হয়ে উপায় ছিল না। বাস্তবে দুজন প্রায় কাছাকাছি বয়সী।
শেখ হাসিনা এই ‘রে পোটাকা’-কে নিজের চরিত্রে অভিনয়ের অনুমোদন দিয়েছেন, এতে অবাক হইনি। জীবনে বহু বেফাঁস কথাবার্তা হাসিনা বলেছেন, তাই তার এই বেফাঁস অনুমোদনও হজম করে নিয়েছি। ফজিলাতুন্নেছা হিশেবে গোটা চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন তিশা। এটাও বিরক্তিকর। তার ক্লিশে কণ্ঠ এই চলচ্চিত্রের জন্য উপযোগী না। তিশা ফজিলাতুন্নেছা চরিত্রে মানানসই ছিলেন— না বয়সে, না কণ্ঠে, না চেহারায়, না ব্যক্তিত্বে, না দক্ষতায়।
সাড়ে তিন দশকের জীবনে যত বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছি, এর মধ্যে শীর্ষ এক-দুইয়ের মধ্যে থাকবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চরিত্রে আরিফিন শুভকে নির্বাচন। এই চরিত্রে শুভকে নির্বাচন করতে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে আগেও লিখেছি, আজও লিখছি। শুভকে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে বাছাই করেছেন, আমৃত্যু তাদের মানসিক সুস্থতা কামনা করে যাব। একজন র্যাম্প মডেল— যিনি কোনোদিন মঞ্চে অভিনয় করেননি, যার কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই, কোনো রাজনৈতিক ঘাত-অভিঘাতে যিনি কখনও সেরেফ মতামতটুকুও দেননি, যিনি পড়ালেখা কই করেছেন এর কোনো ঠিকঠিকানা নেই, যিনি মুক্তিযুদ্ধকে বলেন সেভেন্টি ওয়ান আর ভাষা-আন্দোলনকে ফিফটি টু, যার পেটে পারমাণবিক বোমা ফোটালেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে জড়িত আন্দোলন-সংগ্রামের পূর্বাপর সম্পর্কে দেড়টা বাক্য গুছিয়ে বলতে পারবেন না, যিনি জীবনে স্বেচ্ছায় কোনোদিন একপাতা মুজিবপাঠ করেছেন বলে সন্দেহ আছে; সেরেফ শরীরের উচ্চতায় কাছাকাছি বিধায় তাকে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একটা ‘উপমহাদেশের ইতিহাস ঘুরিয়ে দেওয়া’ চরিত্রে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে— এর চেয়ে বড় শৈল্পিক অনাচার আর হতে পারে না। শুভর ওপর ক্ষোভ নেই, তিনি তার জীবনের সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রমটা এই চলচ্চিত্রের জন্যই করেছেন। ক্ষোভ তাদের ওপর, যারা শুভকে মুজিব চরিত্রে নির্বাচন করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ আমার দেখা নয়াচীন রিভিউ পিডিএফ | শেখ মুজিবুর রহমান PDF
রিয়াজের মতো শুভকেও রূপসজ্জাকাররা টিপেটুপে মুজিব বানিয়ে দিয়েছেন। দু-একটা দৃশ্যে শুভর চেহারা-সুরত নিখুঁত মুজিবই মনে হয়েছে, যেমন— ভুট্টোর সাথে আলোচনাদৃশ্যে, নির্বাচনী প্রচারণার জন্য দুই হাত প্রসারিত করে নৌকা-মিছিলের দৃশ্যে। এ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে স্কুলের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতার ডামি মুজিব মনে হয়েছে। সাতই মার্চের ভাষণে শুভকে মনে হয়েছে একটা বৃহদাকার আপেল। একটা টসটসে অস্ট্রেলিয়ান আপেল ফোঁসফোঁস করে বলছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’— দর্শক হিশেবে এ এক বিরাট দুঃস্বপ্ন। পাকিস্তান গণপরিষদে শুভ ইংরেজিতে যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে মনে হয়েছে— এ যেন বাংলাদেশ টেলিভিশন স্কুলবিতর্ক প্রতিযোগিতা। দেখতে গিয়েছি ‘মুজিব’ চলচ্চিত্র, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে জপ করেছি— ‘হে মাবুদ, অন্য সবাই কথা বলুক; কিন্তু শুধু মুজিবটা যেন মুখ না খোলে, সে যেন শুধু মূকাভিনয় করে।’
একজন লম্বা পুরুষকে চেপেচুপে মুজিব বানিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তার মস্তিষ্কে রাজনৈতিক জ্ঞান না থাকলে তার কণ্ঠনালি থেকে মুজিবসুলভ আওয়াজ বের করা সম্ভব না। শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে ছিলেন পঞ্চান্ন বছর। কিন্তু যারপরনাই রাজনৈতিক চাপ আর দীর্ঘ কারাবাসের ফলে জীবনের শেষ দিকে চেহারা দেখে তাকে সত্তরোর্ধ্ব মনে হতো। শুভর বর্তমান বয়স একচল্লিশ। মুজিব চরিত্রে তাকে যখন বাছা হয়েছিল, তখন তার বয়স ছিল সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ। সত্তরোর্ধ্ব চেহারার মুজিবের চরিত্রে চল্লিশেরও কম বয়সী শুভকে বাছাই করা হয়েছিল। কেন হয়েছিল, এর উত্তর পাওয়া যাবে না কখনও। ভারতীয় উপমহাদেশে শুভ এত অপরিহার্য এক অভিনেতা— জানা ছিল না। শুধু এটুকু বলব— মুজিবের চরিত্রে যারা শুভকে বসিয়েছেন, তাদেরকে কখনও ক্ষমা করব না। শেখ মুজিবুর রহমান চরিত্রে যদি লম্বা লোকই লাগে, তা হলে অন্তত তারিক আনাম খানকে নেওয়া যেত।
‘মুজিব’ দেখে যারা কেঁদে ফেলছেন, তাদের কাউকে বিশ্বাস না করার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেব। এই কান্নাকাটির পেছনে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্য আছে। প্রতি ফোঁটা অশ্রু এরা বিক্রি করবে। এই চলচ্চিত্রে যারা শুভ বা তিশার প্রশংসা করছেন, তাদেরকেও বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শেখ হাসিনা শুভকে যদি একশো ছেচল্লিশবারও ‘আব্বা’ বলে ডাকেন, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন— ‘আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে।’ একইভাবে— শেখ হাসিনা শুভকে আব্বা ডাকলেও শুভই থাকে। পর্যাপ্ত মেকআপ সাঁটালে ওবায়দুল কাদেরকেও মুজিব সাজানো সম্ভব। বিশ্বকাপে যেমন কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই, তেমনি মুজিব চরিত্রেও কাউকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। বিশ্বকাপে খেলবেন দেশের সেরা খেলোয়াড়রা, মুজিব চরিত্রে অভিনয় করবেন দেশের সবচেয়ে দক্ষ ও দাপুটে মঞ্চাভিনেতা।
আরও পড়ুনঃ কারাগারের রোজনামচা সারমর্ম | PDF | বই রিভিউ
যা হোক, প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ‘মুজিব’ দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। কিন্তু সাথে বাচ্চাদেরকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কেননা বাচ্চারা চলচ্চিত্রের পর্দায় যাকে মুজিব হিশেবে দেখবে, বাকি জীবন তাদের মানসপটে তিনিই মুজিব হিশেবে ভাসবেন। কোনো বাচ্চা শুভকে মুজিব বা তিশাকে ফজিলাতুন্নেছা ভেবে বড় হোক— সেটা উচিত হবে না।
কেউ যদি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজ সন্তানকে শেখ মুজিবুর রহমান চেনাতে চান, তা হলে ইউটিউবে সেরেফ ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ লিখে খোঁজ করলেই চলবে। আবদুল গাফফার চৌধুরী বানিয়েছিলেন চলচ্চিত্রটা। তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফজিলাতুন্নেছা চরিত্রে লায়লা হাসান। স্বল্প বাজেটের ছবি। কিন্তু গাফফার চৌধুরী ছবিটা বানিয়েছিলেন ভালোবেসে। তিনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা৷ তিনি জানেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস, তিনি জানেন শেখ মুজিব কে বা কী। তাই ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ বানাতে তার তিরাশি কোটি টাকা লাগেনি। পীযূষও জানেন শেখ মুজিব কী, অভিনয় কী, আন্দোলন-সংগ্রাম কী। তাই, মুজিব চরিত্রে মানিয়ে নিতে তারও মুজিবের মতো লম্বা হতে হয়নি। খাটো পীযূষই দীর্ঘ মুজিবের চরিত্র দোর্দণ্ড প্রতাপে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনয়ের জোরে, কণ্ঠের জোরে, ব্যক্তিত্বের জোরে। একটা ব্যাপার অন্তরে ধারণ না করলে কাগজে-কলমে বা রুপালি পর্দায় সেটাকে ফুটিয়ে তোলা যাবেই না, ফাঁপা জায়গাটা ধরা পড়বেই। ফাঁপা ধরতে পেরেও যে ফাঁপরবাজরা এর প্রশংসা করবে, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।