যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “হৃদয়ের বৃত্তি, ইংরেজিতে যাহাকে emotion বলে তাহা আমাদের হৃদয়ের আবেগ, অর্থাৎ গতি, তাহার সহিত বিশ্বকম্পনের একটা মহা ঐক্য আছে। আলোকের সহিত, বর্ণের ধ্বনির সহিত, তাপের সহিত তাহার একটা স্পন্দনের যোগ; একটা সুরের মিল আছে।…এই রূপে প্রবল স্পন্দনে আমাদিগকে বিশ্ব স্পন্দনের সহিত যুক্ত করিয়া দেয়।…তখন আমরা সমস্ত জগতের সহিত এতকালৈ পা ফেলিতে থাকি,….।” অন্যত্র বলেছেন, “নৌকার গুণ নৌকাকে বাঁধিয়া রাখে নাই, নৌকাকে টানিয়া টায়িা লইয়া চলিয়াছে। জগতের সমস্ত আকর্ষণ-পাশ আমাদিগকে তেমনি অগ্রসর করিতেছে।…ইহাকেই তো আমি মুক্তির সাধনা বলি।” সুকান্ত কী তবে সেই মুক্তির সাধনা করে গেছেন?
সোনার তরীতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে/আমি একা বসে রব, মুক্তি আধারিতে?” অন্যত্র বলেছেন, “জন্মেছি যে মর্তকোলে ঘৃণা করি, তারে ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে।”
রবীন্দ্রনাথ যে শুধু গীতি কবিতায় আচ্ছন্ন ছিলেন তা নয়। তিনি অনেক কিছুর পূর্বাভাসও দিয়ে গেছেন তাঁর নব নব সৃষ্টিতে। তিনি বলেছেন, “মানবজীবন ‘পাইনি’ ও ‘পেয়েছি’ দিয়ে গঠিত।…মানুষের কাছে পেয়েছিলও একটা ডাক আছে, আর পাইনিও ডাক প্রবল।” সে ‘পাইনি’র প্রবল ডাক সুকান্তর কানে ভীষণভাবে বেজেছে। তাই পচাগলা সমাজের পরিবর্তে কামনা করেন এক নতুন শোষণহীন সমাজের। আর এই শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি কোন দেবতার বা ঐশী শক্তির দ্বারস্থ হতে চাননি;তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন জনতার। ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতাই তাঁকে এনে দিয়েছে এ সকল মহৎ গুণাবলী। আর তাঁর এ সকল গুণাবলীই ভরে উঠেছে ‘পূর্বাভাস’ এর ছত্রে ছত্রে। ২৮টি কবিতা নিয়ে রয়েছে ‘সহসা’, ‘হে পৃথিবী’, ‘সুতরাং’, ‘আমার মৃত্যুর পর’ ও ‘অসহ্যদিন’-এর মত ক্ষুদ্রায়তনের কবিতা। আছে সর্বজনপ্রিয় কবিতা ‘উদ্যোগ’ এবং ‘দুর্মর’।
আরও পড়ুনঃ মিঠেকড়া PDF | রিভিউ | সুকান্ত ভট্টাচার্য | Mithekora by Sukanta
‘পূর্বাভাস’ এর শুরুতে কবি ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে, চাঁদকে দেখেছেন ম্লান। কালমৃত্যুও এখানে এসে ফিরে যায়। আর এখানেই সুকান্ত আবিষ্কার করেন তাঁর জয়কে। বন্যার বেগে মুক্তির ঢেউ এসে তাঁকে আলিঙ্গন করে। তাই ‘নিবৃত্তির পূর্বে’ কবিতায় কবি-কণ্ঠ গেয়ে উঠেন, “দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে।” সামাজিক ন্যায় বিচারকে, সাম্যকে কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপন করা বড় কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আশ্চর্যের বিষয় হল সে কঠিন কাজটি নিপুণভাবে সমাধা করতে পেরেছেন সুকান্ত । আর এজন্যই বোধহয় বিশ্বব্যাপী একটি কিশোরের এত কদর। বিশ্বের সকল প্রগতিশীলের মত সুকান্তও মৃত্যুকে ভুলতে পেরেছিলেন। ‘বুদ্বুদমাত্র’ কবিতায় তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-
“মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই,
তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই ।”এছাড়া উপায় কি?
“জন্মের প্রথম কাল হতে,
অমিরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে।”
গতানুগতিক পৃথিবী সত্যি কুশলী। এখানে সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের কোন ঠাঁই নেই । পৃথিবী ও স্বার্থান্বেষী মানুষের মত ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’। ইতিহাসও বড়বেশি স্বার্থপর। তাইতো দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব-বস্তুতে-বস্তুতে; শ্রেণীতে-শ্রেণীতে, সমাজে-সমাজে, মালিক-শ্রমিকে; জালেম মজলুমে; শোষক আর শোষিতে। এ দ্বন্দ্ব চিরদিনের। শ্রেণীহীন সমাজই এর একমাত্র সমাধান। যাঁরা শোষিতের দলে তাঁদেরই বেঁচে থাকা সার্থক । তাঁদের বাঁচার প্রয়োজন আছে। শোষকের স্বপ্ন-দুর্গ ভেঙে চুরমার না করা পর্যন্ত শোষিতের বিরাম নেই। সুকান্তরও বিরাম ছিল না। তাঁর জীবনের একটি মুহূর্তও বৃথা যায়নি। বৃথা যেতে দেয়নি। কারণ-
“মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা, যে মুহূর্ত
তোমার আমার আর অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা”
(মুহূর্ত কবিতা থেকে)
আরও পড়ুনঃ সুকান্ত সমগ্র | Sukanta Samagra PDF | সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা সমগ্র
মাওসেতুং-এর গল্পের বুড়োর মত আমাদেরও পাহাড় ভাঙতে হবে। ভাঙতে হবে সামনের উদ্ধত প্রাচীর । এক জনমে না পারি জন্ম-জন্মান্তরে ভাংগতে হবে সকল বাধা। ‘মুহূর্ত’ কবিতায় একজন্য সুকান্ত বলেন,
“প্রত্যেক মুহূর্ত আনাগত মুহূর্তের রক্তিম কপোলে
তুলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা ।”
‘উদ্যোগ’ সুকান্তর উত্তম কবিতার একটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বদৌলতে সর্বত্র মন্ত্রের মত আবৃত্তি করা হতো এই কবিতাটি,
“বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ কর চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।”
তাঁর আহ্বান তন্দ্রাকে ছিন্ন করে শত্রুকে রুখতে হবে, নিশ্চিহ্ন করতে হবে। হাতিয়ারে শান দিতে হবে। আর এই তো সময়। ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা প্রসব ব্যথায় কাঁদছে। নুতন দিনেরা সমাগত। ভীরু, গুপ্ত ঘাতকদের এদেশ থেকে পালাতে হবে। নূতন দিনের স্বপ্নে কোটি জনতা এখন মগ্ন। সবাই সংঘবদ্ধ এবং প্রস্তুত। ‘বিভীষণের প্রতি’ কবিতায় সুকান্ত বলেন-
“মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ,
তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত।”
আরও পড়ুনঃ হরতাল PDF | সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতা রিভিউ | Hartal by Sukanta
যে কোন কাজেই ঐক্যের প্রয়োজন। যত কঠিন কাজ তত বেশি ঐক্য চাই । একটা সমাজ বদলানো, দুনিয়া বদলানো বড় কঠিন কাজ। এজন্য চাই ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য ভুলতে হবে দ্বন্দ্ব, বিভেদ ও হামবড়াভাব। তাই-
“আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর হাতে কর বর্জন,
আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন;
…
সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির।”
(‘জাগবার দিন আজ’ কবিতা থেকে)
ঘুমপাড়ানোর গান নয়, ঘুম ভাঙার গান নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সুকান্ত। মৃতের জানাযা পাঠ করারও যেন সময় নেই আজ। জীবনের দাবীর কাছে মৃত্যু, অশ্রুজল সবকিছুই তুচ্ছ।
লেনিন বলেছেন, বৃদ্ধদের মাথা (অভিজ্ঞতা) যুবকদের কাঁধে রাখার জন্য। কারণ বৃদ্ধের আছে অভিজ্ঞতা, তরুণের আছে দেহবল। মনোবল আর দেহবল-দুনিয়া বদলাতে দুই-ই দরকার। তরুণ ছাড়া প্রচণ্ড ধ্বংস এবং তারপর গড়া সম্ভব নয়। এজন্য আধ মরাদের ঘা মারতে রবীন্দ্রনাথ ডেকেছেন তরুণকে। নজরুল আজীবন গেয়েছেন তরুণের জয়গান। সুকান্তও এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম নয়। ‘তারুণ্য’ কবিতায় তরুণেরই জয়গান গেয়েছেন তিনি। তারুণ্যের ওপর ভরসা রেখেই সুকান্ত উচ্চারণ করেছেন-
“ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুধিত পৃথিবী/আর সর্পিল সভ্যতা।…
আরও পড়ুনঃ ঘুম নেই PDF | সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতা | Ghum Nei by Sukanta
‘ছাড়পত্র’র ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটির সাথে ‘তারুণ্য’ কবিতাটির অনেক পঙক্তিরই নিকট-সম্পর্ক বিদ্যমান। তারুণ্য কবিতার…’হায়রে পৃথিবী,/তারুণ্যের মর্মকথা কে বোঝাবে তোরে!” অথবা সুকান্ত যখন বলেন-“তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা!” তখন, “আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর/তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা।”-সে কথাই যেন ‘আমাদের’ কানে বাজে। পৃথিবী একদিন শত্রুমুক্ত হবে। প্রত্যেকটি মানুষ শান্তিতে থাকবে। সাম্যবাদী মাত্রই এ স্বাধীনতার কথা, শান্তির কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এবং সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যান। ‘মৃত পৃথিবী’ কবিতায় সুকান্তর দৃঢ়বিশ্বাস-
“জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত,
তবুতো হৃদয় উদীপ্ত,
বোধহয় আগামী কোন বন্যায়,
ভেসে যাবে অনশন, অন্যায়।”
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, একদিন সকল অন্যায় ভেসে যাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্যবাদী সমাজ। ১৯৪১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবে নজরুল ঘোষণা করেন,
“হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ অভাব-অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মত জমা হয়ে আছে-এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ- সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।”
আরও পড়ুনঃ পত্রগুচ্ছ | সুকান্ত ভট্টাচার্য | PDF | Sukanta Bhattacharya
‘পূর্বাভাস’-এর শেষোক্ত কবিতাটির নাম ‘দুর্মর’। ‘দুর্মর’ কবিতাটি একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন কবিতা; দেশ ও মাটির সার্থক কবিতা। কবিতাটি বার বার পাঠ করলেও যেন তৃপ্তি মেটে না।
“হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ।
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ ।
“হয় ধান নয় প্রাণ” এ শব্দে সারাদেশ দিশাহারা,
একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা।
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।
এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালী নয়কো রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।”
আরও পড়ুনঃ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনী | ১ম পর্ব | সম্পূর্ণ জীবন কাহিনী | Sukanta