যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
প্রকাশের প্রথম দিনেই বইটি নন-ফিকশন বিভাগে রকমারি বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষ স্থানে চলে এসেছে। বাংলাদেশের মাত্র এক লাখ তরুণ যদি এ বইটি পড়ে ফেলে, তাহলে ৩০ বছর পর আমরা একটি নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ পেতে পারি। প্রকাশক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন— বইটি ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র‘-কেও ছাড়িয়ে যাবে।
“প্রকাশক হিশেবে সাধারণত কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি একবার উল্টে-পাল্টে দেখি। কিন্তু মহিউদ্দিন মোহাম্মদের এ বইটির পাণ্ডুলিপি চারবার পড়েছি। প্রকাশক হিশেবে একবার, পাঠক হিশেবে তিনবার। প্রতি পাঠেই বইটিকে নতুন করে উপলব্ধি করেছি, এবং পরিচিত বহু বিষয় ও সংকট নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করেছি। পাঠক কেন এ বইটির জন্য এতো মুখিয়ে আছে, বইমেলা ২০২৩-এর প্রথম দিন থেকেই কেন তারা এ বইটিকে এতো খোঁজাখুঁজি করছে, তা প্রথম পাঠেই বুঝে গিয়েছি। ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ এবং ‘টয়োটা করোলা’— এ দুটি বইয়ে লেখক সাধারণত স্যাটায়ার ও আবছা ইঙ্গিতে কথা বলেছেন। কিন্তু এ বইয়ে বলেছেন সরাসরি। স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায়। এ কাজে ‘শয়তান’ ও ‘জিব্রাইল’ নামের দুটি চরিত্রকে মাউথপিস হিশেবে ব্যবহার করেছেন। ‘ইবলিশ’ নামেও একটি আলাদা চরিত্র নির্মাণের প্রয়াস নিয়েছেন। ‘শয়তান’ শব্দটির যে-স্টেরিওটাইপ, তা ‘ইবলিশ’ শব্দটি দ্বারা এ বইয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ নন-ফিকশনের একটি ফিকশনালাইজেশন এখানে ঘটেছে।
বইটি ছয় পর্বে বিভক্ত। পর্বগুলোকে লেখক আখ্যায়িত করেছেন ‘লিফলেট’ নামে। এ লিফলেটগুলো একপ্রকার প্রবন্ধ, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে শয়তান ও জিব্রাইলের কথোপকথন। জিব্রাইল এখানে পালন করেছেন লেখকের ভূমিকা। যেন মূল লেখক জিব্রাইলের মাধ্যমে নিজেকে আড়াল করেছেন। শয়তান প্রশ্ন করেছেন, জিব্রাইল উত্তর দিয়েছেন। জ্ঞানপিপাসু কোনো উৎসুক জনতা হঠাৎ দার্শনিকবোধসম্পন্ন কারও দেখা পেলে যা ঘটে, এ বইয়ে তাই ঘটেছে।
এমন অনেক স্পর্শকাতর বিষয় এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে, যা নিয়ে সমাজে এখন কথাই বলা যায় না। বহু দুর্বোধ্য বিষয়কে লেখক তাঁর স্বভাবজাত মুন্সিয়ানা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন সুবোধ্য রূপে। বইটির প্রতিটি পাতা কোটেবল। উদ্ধৃতিযোগ্য। যেকোনো পাতা উল্টালেই মনে হবে, পাতাটির ছবি তুলে কাউকে দেখাই। একটি পৃষ্ঠায়ও আজেবাজে কোনো কথা নেই। এটি মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। ফ্যাটহীন চিন্তাবহুল লেখা। ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ এবং ‘টয়োটা করোলা’— এ দুই বইয়েও ব্যাপারটি লক্ষ করেছি। সাধারণত লেখকদের বেলায় “কীভাবে বুঝাবো যে অমুক খুব ভালো লেখক বা বড় সাহিত্যিক?”— এমন প্রশ্নের জবাবে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বেলায় এ হিমশিম খেতে হয় না, কারণ তাঁর বইগুলোর যেকোনো এক পৃষ্ঠা র্যান্ডোমলি উদ্ধৃত করে দিলেই তা প্রমাণ হয়ে যায়। তাঁর লেখা একইসাথে মানসম্পন্ন ও জনপ্রিয়। সবার কাছে জনপ্রিয় বা আরাধ্য, এমনটি বলছি না; অনেকেই তাঁর লেখায় প্রচণ্ড আহত ও ক্ষুব্ধ হন, ফোঁস ফোঁস করেন ভেতরে ভেতরে, কিন্তু তাঁকে এড়ানো কঠিন। একবার তাঁর লেখা পড়ে ফেললে মগজে তিনি স্থায়ীভাবে বসে যান। তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায়, কিন্তু তাঁকে অবহেলা করা যায় না।
বইটিকে কী শ্রেণীতে ফেলবো, তা নিয়ে মুশকিলে আছি। একবার মনে হয় প্রবন্ধ, আরেকবার মনে হয় সাক্ষাৎকার, অন্যবার বোধ হয় উপন্যাস। এর প্রধান কারণ বইটির ন্যারেটিভ স্টাইল। বাংলা ভাষায় এমন আচানক স্টাইলে নন-ফিকশন লেখার কাজ এর আগে কেউ করেছেন বলে মনে পড়ে না। নন-ফিকশন যে ফিকশনের মতো উপভোগ্য ও সাবলীল হতে পারে, অত্যন্ত খটোমটো বিষয়ও যে মানুষের মনের ভাষায় রচনা করা যায়, তা এ বইটি না পড়লে বিশ্বাস হবে না। পুরো বই জুড়ে লেখক যেন পাঠকের সামনে বসে কথা বলে গেছেন আপনজনের মতো।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এ বইয়ে কী আছে? উত্তরে বলতে হবে— কী নেই? সূচিপত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়— অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভূতপূর্ব আলোচনা মুদ্রিত হয়েছে বইটির ছত্রে ছত্রে। সমাজ, প্রথা, ও জাতির উপর যেন এ এক শিলাবৃষ্টি। বইটিতে একটি পৃষ্ঠাও নেই, যা পড়ে পাঠকের ভাবনার জগৎ আন্দোলিত হবে না।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখার ধরন, ভাষা, চিন্তাপদ্ধতি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ও গদ্যের প্রশংসা ইতোপূর্বে অনেক গুণীজনই করেছেন। তাঁর হিংসুক বা নিন্দুকরাও এটি স্বীকার করেন। তবে উনার লেখার আরেকটি বড় গুণ হলো পরিমিতিবোধ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো বাক্য খরচ করেন না। একদম যেন মেপে মেপে লেখেন। মেদহীন ঝরঝরে গদ্য। পাদটীকা ব্যবহার করেন খুবই কম। যে-কথা সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলা, সে-কথা তিনি পাঠকদের উপযোগী ভাষাতেই বর্ণনা করেন। উদাহরণস্বরূপ বিবর্তন তত্ত্বের কথা বলা যায়। এটি সম্পর্কে আগে তেমন কিছু জানতাম না। কেবল ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’— এরকম কিছু শুনতাম। বইপত্রেও স্পষ্ট কোনো ধারণা পেতাম না। শুধু ভাসা ভাসা বক্তব্য নজরে আসতো। কিন্তু এ বইয়ের ‘ডারউইনের বানর’ অধ্যায়টি পড়ে বিষয়টি আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। এরকম আরও অনেক বিষয় শ্রুতিমধুর ফিকশন বা কথোপকথনের মতো বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। একবার পড়লে বারবার পড়ার ইচ্ছা জাগে। মনে হয় কিছুই পড়া হয় নি, আবার পড়ি। একটি ব্যাপার এখান থেকে পরিষ্কার হয়। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ যে-জিনিস নিজে বুঝেন না, সে-জিনিস কখনো অন্যকে বোঝাতে যান না। এ দিক থেকে বলা যায়, বইয়ের মাধ্যমে একইসাথে শিক্ষক ও সমাজ সংস্কারক, দুই ভূমিকাই তিনি পালন করছেন।
আমরা বইটির পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলাম অনেক আগে। কিন্তু বইটির কলেবর বড় হওয়ায়, এবং বিভিন্ন সময়ে লেখক কর্তৃক বারবার পাণ্ডুলিপিতে সংযোজন, বিয়োজন, সম্পাদনা, ও সংশোধনের কারণে তা প্রকাশে বিলম্ব হলো। কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটেছিলো, যা এখানে বলা সমীচীন মনে করছি না।
বইটির সূচিবিন্যাস একটু অন্যরকম। এ জন্য পাঠ করার সময় অধ্যায়গুলোর পরম্পরা বজায় রাখা দরকার। কোনো পর্বে এক অধ্যায় বাদ দিয়ে আরেক অধ্যায় পড়লে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। এ দিকটি পাঠকদের খেয়াল রাখতে হবে। এ বইয়ের সব কথা সবার পছন্দ হবে, এমন নয়। অনেক কথা আপনাকে আনন্দিত করবে, কোনোটি করবে ক্ষুব্ধ। এটি আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। সব বিষয়ের সাথে একমত পোষণ করি নি, আবার কোনো কথাকে হেসে উড়িয়েও দিই নি। প্রতিটি কথাই ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত করেছে এবং প্রতিটি বাক্যই গণমানুষের পক্ষে কথা বলেছে। যদিও বহু জায়গায় তিনি গণমানুষকে আঘাত করেছেন, কিন্তু এটি গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থেই করেছেন বলে মনে হয়েছে। সর্বোপরি বইটি জনগণের জন্য জনগণের উপযোগী ভাষায় লেখা। আমাদের আশা, বইটি পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলবে। মানুষ পাবে নতুন ভোরের সন্ধান।”
শাহীদ হাসান তরফদার
জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
ফেব্রুয়ারি, ২০২৩