যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বইঃ সূর্য দীঘল বাড়ী
লেখকঃ আবু ইসহাক
প্রকাশনী : নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৫
জনরা : ধ্রুপদী বাংলা সাতিহ্য
পৃষ্ঠা : ১১০
দাম : ১৭৫ টাকা
রিভিউ করেছেনঃ Fahim Al Shahriyar
কাহিনী সংক্ষেপ
সূর্য দীঘল বাড়ি-যে বাড়িতে নাকি কেউ টিকতে পারে না। যে বা যারাই দুঃসাহস দেখিয়ে সেই সূর্য দীঘল বাড়িতে থাকতে এসেছে তারই কপালে নেমে এসেছে ঘোর বিপদ, তার বংশ হয়েছে নির্বংশ। তা কেনো এই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ অভিশপ্ত? কেনো এটিকে নিয়ে গ্রামে সবার মুখে মুখে নানান কিচ্ছা-কাহিনী ঘুরে বেড়ায়, কেনো এখানে কেউ টিকতে পারে না- এত সব না ভেবেই গ্রামের এক প্রান্তের একমাত্র সূর্য দীঘল বাড়িটিতে হঠাৎ একদিন এসে ওঠে জয়গুন ও তার দুই সন্তান এবং শফিকে নিয়ে শফির মা। ওঠে বলার থেকে আশ্রয় নিয়েছে বললেই বোধহয় যুক্তিযুক্ত হবে, কারণ তাদের আর কোথাও মাথা গুজবার ঠায় ছিল না। থাকলে কি আর জেনে শুনে এই অপয়া-অভিশপ্ত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ তে এসে কেউ আশ্রয় নেয়! প্রাণের মায়া কি তাদের নেই?
কিন্তু পেটে ক্ষিদে নিয়ে এক বেলা কোন মতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতেই যেখানেই জীবনের সাথে চরম লড়াই করতে হয় সেখানে কি প্রাণের ভয় করলে কি চলে? চলে না। তাই শুরুতে জয়গুন আর শফির মা ভয়ে ভয়ে দিন কাটালেও এক সময় এসে, ‘কালকে কি খাবে? সেই খাবার টুকু কিভাবে জোগাড় করবে কিংবা আদৌ জোগাড় করতে পারবে কিনা’ এই চিন্তার কাছে তাদের ভয় ডর শ্রেফ কর্পূরের মত উবে যায়। চলতে থাকে অবিরত সমাজের তোয়াক্কা না করে বেঁচে থাকার এক অবাস্তবিক সত্য লড়াই- হয় লড়ো নয়ত মরো।
এভাবেই দু’মুটো ভাত জোগানের চিন্তায় দিন কেটে যায় তাদের। শফির মা বয়সের ভারে কাজ করতে না পেরে শেষমেশ ভিক্ষাবৃত্তি আশ্রয় নিলেও মরদা জয়গুন চুপ করে বসে থাকে না। সমাজের তথাকথিত লাজ-লজ্জার পর্দার ঠুনকো অযুহাতের যে শিকল যুগ যুগ ধরে নারীকে ঘরে আটকে রেখেছে, নারীকে করেছে পঙ্গু; সেই শিকল এক টানে ছিড়ে-ফুড়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বেরিয়ে পড়ে জয়গুন। আদতে তাকে যে বেড়িয়ে আসতেই হত, আর যে কোন পথই খোলা ছিল না তার কাছে; নইলে সে নিজে খাবে কি আর ছেলে-মেয়ে দু’টোর মুখেই বা কি তুলে দিবে? নিজে নাহয় না খেয়ে কোন মতে থাকতে পারে, তাই বলে তার বাচ্চা দু’টো তো কোন দোষ করে নি। তাইত কয়েক আনায় কমে চাল পাওয়া যাবে বলে রোজ সকালে জয়গুনকে পাড়ি দিতে হয় অনেকটা পথ। ওদিকে বড় ছেলে হাসুও তার এই ছোট্ট বয়সে বুঝে গেছে তার মার পক্ষে একা সংসার চালানো সম্ভব না। তাইত ছোট বোন মায়মুনক একলা ঘরে রেখে মায়ের সাথে সাথে রোজ সকালে সেও বেড়িয়ে পরে জীবিকার তাগিদে। তার অপরিপক্ক দুই কাঁধে ইস্টিশনের বাবুদের ভারি ভারি বোঝা টেনে সংসারের বোঝা হালকা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে-এতে যদি তার প্রাণ যায় তো যাক না!
আরও পড়ুনঃ মহাপতঙ্গ আবু ইসহাক PDF | Mohapotongo by Abu Ishak
কিন্তু তার পরেও জয়গুনের চিন্তার কোন শেষ নেই, রাতে দু’চোখে ঘুম আসতে চায় না। চোখ বুঝলেই রাজ্যের দুঃচিন্তায় তার মাথা ভার হয়ে আসে। বারবার মনে পড়ে কাসুর কথা। তার দ্বিতীয় স্বামী করিম বকসের ঘরের সন্তান। করিম বকসের উগ্র মেজাজ, সেই সাথে নিয়মিত মারের হাত আর সহ্য করতে না পেরে শেষে নিরুপায় হয়ে তার কোলের ধন, তিন বছর বয়সী কাসুকে ফেলে চলে আসতে বাধ্য হয় সে। এরপর আর করিম বকস কাসুকে তার সাথে দেখা করতে দেয় নি-সে ভাবে, হয়ত জয়গুন কাসুকে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কথায় আছে না, বুকের ধন না সরিয়ে রাখা যায় বেশিক্ষণ। তেমনি কাসুকেও খুব বেশিদিন করিম বকস ‘তোর মা মইরা গেছে’ এই মিথ্যে বলে আটকে রাখতে পারে না। একদা মিলন হয় মা ছেলের। কিন্তু? তবু কিছু কিন্তু রয়েই যায়। এমনও হাজারও কিন্তুতেই তো আমাদের মানব জীবন ঘেরা। তাই না?
পরিবারের ‘কিন্ত’, সমাজের ‘কিন্ত’, ভালোবাসার মানুষের ‘কিন্ত’, কাছের মানুষের ‘কিন্ত’, দূরের মানুষের ‘কিন্ত’-এমন বহু ‘কিন্ত’ থেকে বাঁচবার কোন পথ নেই! নেই কোন সংক্ষিপ্ত সমাধান। তবে তাই বলে কি জয়গুনের মত ইস্পাত কঠিন হৃদয়ের নারীও এতসব ‘কিন্ত’র মাঝে দমে যাবে? অটল-অবিচল থাকতে পারবে না? পারবে না তাদের এই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’তে টিকে থাকতে? জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে আবু ইসহাকের কালজয়ী উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। যা আপনাকে মুখোমুখি দাঁড় করাবে এমনই কিছু মানব জীবনের রূঢ় সত্য জীবনবোধের বিপরীতে। তো পাঠক, আপনি প্রস্তুত তো?!
পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা
আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’কে বলা হয় দুইবাংলার যে ক’টি সার্থক উপন্যাস আছে, তার মধ্যে অন্যতম। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই উপন্যাসটা ঠিক কতটা অসাধারণ।
এবার আসি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটি পড়ে আমার নিজস্ব মতামত নিয়ে। প্রথমত আমি বলব, আসলেই এটা একটা সার্থক উপন্যাস। কি নেই এতে? আছে মানব জীবনের বিভিন্ন অপ্রিয় সত্য, আছে সমাজে নারীকে ধর্মের অযুহাতে পর্দার নামে অদৃশ্য শিকল পড়ানোর মত কঠিন দিক, আছে গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যের পাশাপাশি চিরাচরিত ডার্টি ভিলেজ পলেটিক্স, আছে দ্রব্য মূলের বৃদ্ধিতে জনসাধারণের কাঁধে বেতালের মত না চাইতেও চেপে বসা এক ভূতের গল্প, যা কিনা এই ২০২২ সালে এসেও পাঠকগণ শতভাগ অনুধাবন করতে পারবেন। আর কি কিছু নেই? হ্যাঁ, আর আছে এক পরিবারের বেঁচে থাকার অক্লান্ত চেষ্টার গল্প, আছে এক অসহায় মায়ের হার না মানা অপরাজেয় সংগ্রামের গল্প। পাঠক, যা আপনাকে পড়ার সময় ক্ষণে ক্ষণে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে। আপনাকে হাসাবে, আপনাকে কাঁদাবে এবং দিনশেষে আপনাকে মানব জীবনের অন্ধকার রূঢ় বাস্তবতা ও গভীর জীবনবোধ নিয়ে একান্তভাবে ভাবতেও বাধ্য করবে।
আরও পড়ুনঃ বাংলা একাডেমী সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান সম্পাদক আবু ইসহাক
লেখকের লেখনশৈলী
আমার পড়া আবু ইসহাকের প্রথম বই ছিল তাঁর লেখা ‘কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস’ জনরার বই ‘জাল’। সেই বইটি পড়ে খুবই ভালো লেগেছিল। খুবই সাবলীল ওনার লেখনি। কিন্তু এরপর যখন লেখকের এই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ পড়া শুরু করলাম, প্রথমদিকে সত্যি বলতে খাপ খাইয়ে নিতে রীতিমত একটু কষ্টই হচ্ছিলো। প্রচুর আঞ্চলিক-গ্রামীণ ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও বই এর শেষে সহায়ক হিসাবে প্রতিটি আঞ্চলিক শব্দের অর্থ দেওয়া ছিল। তবু বার বার পড়ার সময় পেজ উল্টিয়ে শব্দার্থ দেখে নেওয়াটা একটু ঝামেলাই লেগেছে। কিন্তু এই সমস্যা শুধুমাত্র প্রথম ১০-১৫ পেজেই সীমাবদ্ধ ছিল। একবার আবু ইসহাকের সাবলীল লেখনী এবং শক্তিশালী গল্প বলার ফাঁদে আপনি আটকে গেলে তখন আর কোন পড়তে কোন সমস্যাই হবে না। স্রোতের টানে তর তর করে এগিয়ে যাবেন, এবং কখন যে গন্তব্যে পৌছে যাবেন, টেরও পাবেন না।
কারণ লেখক আবু ইসহাক খুবই সাবলীল ভাবে তার গল্প এবং গল্পের চরিত্রদেরকে এগিয়ে নিয়ে যান। মনুষ্য সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ জটিলতার থেকে সম্পর্কগুলোর বিশেষ বৈশিষ্টের দিকেই তাঁর লেখার ঝোঁকটা থাকে বেশি। এছাড়া হিউম্যান ইমোশনের যে দিকগুলো, সেগুলো তিনি অতিরঞ্জিত করে চরিত্রদের জন্য এক্সট্রা সিম্পেথি আদায় করার অহেতুক চেষ্টা করেন নি। বরং অ্যাজ ইট ইজ বা স্ট্রেইট-কাট রাখার চেষ্টা করেছেন। তা হক সেটা জয়গুন, মায়মুন, হাসু, কাসু, শফি কিংবা শফির মার গল্প বা হক সেটা গদু পরধান কিংবা করিম বকস; সবার সাথেই পাঠক হিসাবে সহজে রিলেইট করা যায়। তাদের কষ্টে যেমন আপনি কষ্ট পাবেন, তেমনি তাদের প্রতিটি কথা আপনাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে, গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে-এ যেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুনঃ পদ্মার পলিদ্বীপ আবু ইসহাক PDF | Poddar Poli Dip by Abu Ishak
এক নজরে ভালো লাগার দিকগুলো
✓ আমরা পাঠ্যবই এ ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, আগের কালের মানুষের কোন দুঃখ-কষ্ট ছিল না। সবার গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভর্তি মাছ ছিল। কিন্তু আদৌ কি তাই? উত্তর না। কারণ বইটিতে লেখক খুব সুন্দর ভাবে সেই ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময়কার মানুষের অসহায়ত্ব, দুঃখ-দুর্দশা, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটকে তুলে ধরেছেন।
✓ ধর্মের ঠুনকো দোহাই দিয়ে নারীকে আটকে রাখার যে প্রচেষ্টা যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলে আসছে, তা যেমন আজকের দিনেও বিদ্যমান তেমনি সেকালেও ছিল বৈকি। সেটাই লেখক এখানে জয়গুনের চরিত্রটির মধ্য দিয়ে দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
✓ প্লটের মাঝে সাবপ্লট দিয়ে কাহিনী না পেঁচিয়ে সাবলীল লেখনীতে গল্প এগিয়ে গেছে। যা আপনাকে কাহিনীর সাথে জুড়তে দারুন ভাবে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুনঃ জাল আবু ইসহাক PDF | গোয়েন্দা উপন্যাস বুক রিভিউ | Jal Abu Ishak
এক নজরে ভালো না লাগার দিকগুলো
✓ যারা আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭) এবং শহীদুল্লা কায়সারের ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২) পড়েছেন তাদের কাছে আবু ইসহাকের এই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ একটু ফিকে লাগতে পারে। কারণ এখানে হক সেটা ভিলেজ পলেটিক্স কিংবা হিউম্যান রিলেশন কোনটাকেই গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয় নি। যা কিনা অন্য দু’টি বইতে বেশ দারুন ভাবে করা হয়েছে। (যদিও ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ আগে প্রকাশিত, ১৯৫৫ সালে)
✓ বইটিতে আঞ্চলিক-গ্রামীণ ভাষার ব্যবহার একটু বেশিই বলা চলে। আমরা যারা শহুরে জীবনযাপন করি, শহরেই বেড়ে ওঠা তাদের জন্য শুরুতে পড়ার সময় একটু সমস্যা হলেও হতে পারে।
সব শেষে এটাই বলব, সর্বোপরি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ আসলেই একটি ক্লাসিক বই। এমনিতেই এটাকে দুই বাংলার অন্যতম সার্থক উপন্যাস বলা হয় না। তাই পাঠক, অত শত না ভাবে বইটি হাতের কাছে পেলে জাস্ট পড়ে ফেলুন। আশা করি আপনার ভালোই লাগবে। ভালো থাকুন, ভালোবাসা হোক শুধু বই এর সাথে।
আরও পড়ুনঃ নির্বাচিত গল্প সমগ্র | আবু ইসহাক | Nirbachito Golpo Somgro | PDF