Skip to content
Home » পল্লীসমাজ উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় PDF | রিভিউ Palli Samaj

পল্লীসমাজ উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় PDF | রিভিউ Palli Samaj

পল্লীসমাজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় PDF রিভিউ

যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

বইঃ পল্লীসমাজ
লেখকঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সাতাশ বছর বয়সী মধ্যশিক্ষিত এক সংবেদনশীল বাঙালি যুবক ভাগ্যান্বেষণে এসেছেন বর্মায়, বতর্মানে যে-দেশটির নাম মায়ানমার। ছোটখাট একটা চাকরি করেন—করণিকের। চাকরির পর অফুরন্ত অবসর। মিলে গেল দর্শন সাহিত্য ইতিহাস বিষয়ে নানা ধরনের বই পড়বার সুযোগ। বছর সাতেক আগে বিহারের সীমান্তবর্তী একটি মফস্বল শহর ভাগলপুরে যখন এই যুবক বাস করতেন, তখন তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সাহিত্যচক্র। সেই সাহিত্যচক্রেরই কয়েকজন হঠাৎ একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন।

কোনো অনুমতি না নিয়ে ওই যুবকের পরিত্যক্ত একটি খাতায় লেখা কয়েকটি গল্প কলকাতার প্রখ্যাত সাহিত্য-পত্রিকা ভারতী, যমুনা ও সাহিত্যে ছেপে দিলেন। গল্পগুলির নাম বড়দিদি, বোঝা, বাল্যস্মৃতি ও কাশিনাথ। প্রথম গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের মাঝে বেশ হৈচৈ পড়ে গেল। দেখা দিল তীব্র কৌতূহল। কে এই গল্পের লেখক? নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ। তা না হলে কে এত চমৎকার গল্প লিখবেন? রবীন্দ্রনাথও বিব্রত। কিন্তু নতুন এক লেখকের আবির্ভাবে তিনি দারুণ অভিভূত। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, সমকালীন গল্পরসপিপাসু বাঙালি পাঠককুল সাদরে স্বাগত জানালেন এই নতুন লেখককে। খবরটা বর্মাতেও যুবকের কানে পৌঁছে গেল।

Download Now

সাহিত্যচক্রের বন্ধুবান্ধব, পত্রিকাসম্পাদক, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পাকাপাকিভাবে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হবার জন্যে তাঁকে আহ্বান জানালেন। প্রায় আকস্মিকভাবে বাংলা সাহিত্যে এভাবে যাঁর আবির্ভাব ঘটল, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক।

পল্লীসমাজ (১৯১৬) শরৎচন্দ্রের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। উপন্যাসটি একাধারে জনপ্রিয় ও বিতর্কিত। শরৎচন্দ্রের জীবনকে চারটি পর্বে ভাগ করা হয় : দেবানন্দপুর-ভাগলপুর পর্ব (১৮৭৬-১৯০২), ব্রহ্মদেশ পর্ব (১৯০৩-১৬), হাওড়া-শিবপুর পর্ব (১৯১৬-২৫) এবং সামতাবেড়-কলকাতা পর্ব (১৯২৬-৩৮)। পল্লীসমাজ তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্বে লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব যেমন আকস্মিকভাবে ঘটেছিল, তেমনি তাঁর সময়টিও ছিল ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল।

রবীন্দ্রনাথের মতোই দুই শতাব্দী জুড়ে ছিল শরতন্দ্রের সাহিত্যজীবন। ঔপনিবেশিক শক্তি ততদিনে ভারতে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ভারতীয়রা উন্মুখ। মাঝে একটি বিশ্বযুদ্ধ ও সংঘটিত হয়ে গেছে। পল্লীসমাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে শরত্চন্দ্রের জীবন ও সময়ের প্রেক্ষাপটেই তা করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। কেননা শরৎচন্দ্র এমন একজন কথাসাহিত্যিক, যিনি আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতাকে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাস ও গল্পে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করেছেন।

Download Now

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর (৩১ ভাদ্র ১২৮৩) শরত্চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উপার্জনবিমুখ, আত্মভোলা, বেহিসেবী, স্বপ্নবিলাসী, সাহিত্যানুরাগী মানুষ। মাতা ভুবনমোহিনী দেবী ছিলেন ‘শাস্তস্বভাবা, ধৈর্যশীলা, গৃহকর্মেনিরতা ও সেবাপরায়ণা’ রমণী। পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠপুত্র শরতন্দ্রের বাদ্য ও কৈশোরের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় ভাগলপুরের মাতুলালয়ে। শরত্চন্দ্র পড়াশোনা করেন দেবানন্দপুর, হুগলী ও ভাগলপুরে। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ (১৮৯৪) করার পর দারিদ্র্যের কারণে টেস্ট পরীক্ষার সময় কলেজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তাঁর ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে।

আরও পড়ুনঃ বিষবৃক্ষ উপন্যাসের সারাংশ বিষয়বস্তু চরিত্র | Bishabriksha Novel PDF

মা ও বাবার মৃত্যুর পর চাকরির সন্ধানে তিনি কলকাতা চলে আসেন। কলকাতা হাইকোর্টে লাভ করেন অনুবাদকের কাজ। এরপর এ-কাজ ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে রেঙ্গুন চলে যান। বর্মা রেলে গ্রহণ করেন করণিকের কাজ। এই সময়েই শাস্তি দেবীকে বিয়ে করেন। কিন্তু প্লেগে তিনি মারা গেলে হিরন্ময়ী দেবীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করেন। বৰ্মা থাকাকালেই বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আবির্ভাবের ঘটনাটি যে কতটা চমকপ্রদ ছিল, এই লেখার শুরুতেই তা উল্লেখ করেছি। কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রধানত সাহিত্যচর্চার টানে ১৯১৬ সালে তিনি দেশে চলে আসেন। পরবর্তীকালে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২১) যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৩৬ সালে ৬১তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ শরত্চন্দ্রকে বাংলা সাহিত্যের একজন মহৎ ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিনন্দিত করেন। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি (২ মাঘ ১৩৪৪) কলকাতার পার্ক নার্সিং হোমে মহাপ্রয়াণ ঘটে বাংলা সাহিত্যের এই জনপ্রিয় লেখকের। অবসান ঘটে একটি যুগের।

Download Now

ঊনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণের শেষ পর্যায়ে শরত্চন্দ্র অনুগ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব ও চিন্তাচেতনার প্রভাবে ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বিচলন দেখা দিয়েছে। মধ্যযুগীয় ভাবনা, সংস্কার ও আচার-আচরণ অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রবল হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ভারতীয় সমাজে অবশ্য তখনও প্রাচীনপন্থীদের প্রাধান্য অবসিত হয়ে যায়নি।

আধুনিক ও প্রাচীনের দ্বন্দ্বও তাই মাঝে মাঝে বাঙালি জীবনকে সংক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রথম দিকে নবজাগরণের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবকালে ওই আন্দোলন ক্রমশ উপনিবেশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ঘুরে যেতে থাকে। শরত্চন্দ্র যে-বছর অনুগ্রহণ করেন, সে-বছরই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতসভা’। এরপর ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ, অসহযোগ, খিলাফত, সন্ত্রাসবাদী—নানা আন্দোলনে বাঙালির জাতীয় জীবন ভীষণভাবে আলোড়িত হয়। নাগরিক জীবনের এ-সব আন্দোলনের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে সংঘটিত নানা কৃষক বিদ্রোহও ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিভূমি নাড়িয়ে দিতে থাকে। সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক এই বিক্ষোভ নৈতিক স্খলনকে সাধারণত প্রশ্রয় দেয় না। শরৎচন্দ্রের জীবনভাবনার এসবই হচ্ছে মৌলসূত্র। ফলে বিপ্লবী ভাবনা ও রক্ষণশীলতা—এই দ্বন্দ্বই তাঁর সকল রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই দ্বন্দ্বের কারণেই তাঁর লেখা বাঙালির এত প্রিয়। কেননা অধিকাংশ বাঙালি পাঠক ওই দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে জীবন নির্বাহ করে।

আরও পড়ুনঃ চোখের বালি পিডিএফ রিভিউ | বাংলা সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস

সমাজ সচেতনতা যেমন শরতন্দ্রকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল, তেমনি এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একজন উদ্দেশ্যপ্রধান লেখক’ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে। শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব এইখানে যে, উদ্দেশ্যপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রচনা প্রচারের পর্যায়ে নেমে আসেনি, তাতে শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ থেকেছে। উদ্দেশ্যের অনুপাত অনুসারে শরৎচন্দ্রের রচনাবলিকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় :
প্রথম শ্রেণী : সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যধর্মী মানবীয় রচনা—বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, একাদশী বৈরাগী।
দ্বিতীয় শ্রেণী : সামাজিক উদ্দেশ্যমূলক রচনা—পল্লীসমাজ, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন।
তৃতীয় শ্রেণী : মনস্তত্ত্বনির্ভর উদ্দেশ্যমূলক রচনা—অরক্ষণীয়া, গৃহদাহ, বামুনের মেয়ে।
চতুর্থ শ্রেণী : সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রধান রচনা— পথের দাবী, শেষপ্রশ্ন।

Download Now

উল্লিখিত শ্রেণীবিভাগ অনুসারে পল্লীসমাজ একটি সামাজিক উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাস। অনতিক্রম্য সামাজিক বন্ধনই এ উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে শরৎচন্দ্র সমস্যা তুলেই ক্ষান্ত হয়েছেন, সমাধানের চেষ্টা করেননি। জীবনের যে-সব অপচয় ও নৈরাশ্যের বেদনা’ তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করেছে, তিনি শুধু তা-ই তুলে ধরেছেন, এসবের কোনো প্রতিকার বা সমাধানের চেষ্টা করেননি। তাঁর শিল্পসৃষ্টি অনুভবময়তা ও প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কোনোকিছু ব্যাখ্যা করেনি বা নতুন করে সৃষ্টিও করতে চায়নি। প্রকৃতপক্ষে শৈল্পিক নিস্পৃহতাই পল্লীসমাজকে একটি মহৎ উপন্যাসে উন্নীত করেছে।

সাহিত্যজীবনের প্রাথমিক পর্বেই শরত্চন্দ্র এই শৈল্পিক গুণটি অর্জন করেছিলেন। শরতন্দ্র যে-বছর বর্মা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন, সে বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর বিতর্কিত ও তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস পল্লীসমাজ। এর আগেই অবশ্য তিনি সাহিত্যখ্যাতি পেয়ে গিয়েছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : পরিণীতা (১৯১৪), বিরাজ বৌ (১৯১৪), পণ্ডিত মশাই (১৯১৪)। পল্লীসমাজ শরৎচন্দ্রের সমাজ-সমালোচনামূলক সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণপ্রধান পল্লীসমাজের স্বরূপ উন্মোচনই এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু।

বেণী ঘোষাল, গোবিন্দ গাঙ্গুলী, পরাণ হালদার প্রমুখ এই সমাজের হর্তাকর্তা। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীপ্রধান সমাজে বর্ণহিন্দুদেরই প্রাধান্য। রমেশও এদেরই একজন। কিন্তু তাঁর অবস্থান সমাজ-সংস্কারকের। সঙ্গে সে পেয়েছে নিম্নবর্গের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষকে। এদেরই বিপরীতে খলনায়করূপী বেণী ঘোষালের অবস্থান। তার হীনমন্যতা ও ষড়যন্ত্রের কুটিল-কঠিন আঘাত রমেশ, রমা বা গ্রামের সাধারণ মানুষ কাউকেই মূহূর্তের জন্যে স্বস্তি দেয়নি। পল্লীসমাজের মূল কথা দুটি : ১. রমা রমেশের প্রেম, গ্রামসমাজের বাধা, এবং ২. রমেশের গ্রামোন্নতির পথে সমাজপতিদের বাধাদান।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। উপনিবেশ-বিরোধী দেশাত্মবোধেরও উদ্বোধন ঘটতে থাকে এই সময়। শরৎচন্দ্র তাঁর লেখার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের এই সামাজিক-রাজনৈতিক ধারাকে সাধারণ মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসেন। নিম্নবর্গের ব্রাত্যজন এবং তাদের সমাজ তাঁর সাহিত্যে স্থান করে নেয়। এ সম্পর্কে একজন সমালোচক বলেছেন : তিনি উপলব্ধি করলেন, এই ‘অশেষ দুঃখের দেশে’ ৰঞ্চিত, অবহেলিত সমাজের নীচুতলার মানুষ যদি সাহিত্যে স্থান না পায় তাহলে সেই সাহিত্য কখনো উন্নত হতে পারে না। সাহিত্যে গণতান্ত্রিকতাকে তিনিই প্রতিষ্ঠিত করলেন। মালো-কৈবর্ত-জোলার জীবন নিয়ে যে সাহিত্য রচনা সম্ভব একথা শরতন্দ্র প্রথম আমাদের দেখালেন। স্বাভাবিকভাবেই শরৎসাহিত্যের প্রধান পটভূমি বাংলাদেশের গ্রামীণসমাজ।

আরও পড়ুনঃ শেষের কবিতা PDF | সারসংক্ষেপ | Shesher Kobita | Read Online

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদাররাই সেই সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক। একদিকে ইংরেজের ব্যাপক লুণ্ঠনবৃত্তি, দেশীয় শিল্পের ধ্বংস সাধন ও অবাধ বাণিজ্যপুঁজির প্রসার, অন্যদিকে শিক্ষিতশ্রেণীর রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলন সমাজ সংস্কারের প্রবণতাকে তীব্রতর করে তুলল। সতীদাহ প্রথা ইতিমধ্যে রহিত হয়ে গেছে, বিধবা বিবাহ বিধিসম্মত, জাতিভেদের কঠোরতা বেশ শিথিল। কিন্তু তখনো এ-সব সামাজিক কুপ্রথা পুরোপুরিভাবে অপসৃত হয়ে যায়নি। বিশেষ করে গ্রামে বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ, কৌলীন্য প্রভৃতি নানা কুসংস্কার বজায় রইল। ফলে নানা তর্ক-বিতর্ক, আক্রমণ প্রতিআক্রমণে ৰাঙালি সমাজ তখন আন্দোলিত, সংক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সংস্কারের জন্যে ভারতীয়রা আবার উন্মুখ। এরকম একটা পটভূমিতে বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে।

Download Now

সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জ যেমন শরৎচন্দ্রের মানসগঠনে সাহায্য করেছিল, তেমনি ব্যক্তিজীবনও শরৎচন্দ্রের জীবনদৃষ্টি গড়ে নিতে সাহায্য করেছে। যৌবনে বর্মায় থাকাকালেই শরত্চন্দ্র উদারমনস্ক হয়ে ওঠেন। উপলব্ধি করেন যে, মানুষের যোগ্যতার বিচারে প্রচলিত নিয়ম-কানুনের প্রশ্ন তোলা সম্পূর্ণ অবান্তর। সামাজিক বিশ্বাস ও প্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ব্যক্তিজীবন স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষে নিমজ্জিত হয়। শরৎচন্দ্র মূলত এই ধরনের দ্বৈত মানসিক অবস্থার মধ্যে থেকে সাহিত্যচর্চা করেছেন। ফলে একদিকে সংস্কার ভাবনা এবং অন্যদিকে সামাজিক রক্ষণশীলতা—বিপরীতধর্মী বিষয়বস্তুর সন্নিবেশে কণ্টকিত তাঁর রচনাবলি। বাংলা সাহিত্যের আবার তিনিই প্রথম লেখক, যিনি সাহিত্যকে পেশা হিশেবে গ্রহণ করেছেন, সথ হিশেবে নয়। সাহিত্যের দিক থেকে এই সিদ্ধান্তটি ছিল সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবাত্মক।

হুমায়ুন কবির লক্ষ করেছেন, এতে শিল্প ও জীবনের মধ্যেকার ব্যবধান ঘুঁচে যায়। সাহিত্যের পরিধি বিস্তৃত হয়ে বাজারের স্তরে নেমে আসে। শরৎচন্দ্র তাঁর রচনায় সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষকে যে পরম সহানুভূতির সঙ্গে উপজীব্য করেছিলেন, সেই সূত্রটি এখানেই লুকিয়ে আছে। নারী ও পুরুষ সম্পর্কেও শরত্চন্দ্র ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। পুরুষ প্রবৃত্তির দ্বারা যতটা তাড়িত, সামাজিক ফল সম্বন্ধে ততটাই উদাসীন।

অন্যদিকে যৌনচরিতার্থতাই নারীর শেষকথা নয়, মাতৃত্বের সার্থকতায় তার প্রবৃত্তির পূর্ণ পরিতৃপ্তি। পুরুষ তাই সামাজিক অনুশাসন সম্বন্ধে যেমন উদাসীন, তেমনি প্রেমের পরিণাম সম্পর্কে অনাগ্রহী। তুলনায় নারী চায় স্থিতি, আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের সঙ্গে ঘর বাধতে। সামাজিক অনুশাসনকে সে মেনে চলে, কুয়াপুর গ্রামের জমিদার তারিণী ঘোষাল ও যদু মুখুজ্যের পারিবারিক কলহ ও শত্রুতাই হল পল্লীসমাজের কাহিনী। এর একদিকে রয়েছে প্রজাপীড়ক বেণী ঘোষাল ও রমা এবং অন্যদিকে প্রজাহিতৈষী রমেশ। এখানে গ্রামের জমিদারে জমিদারে চলে কুৎসিৎ দ্বন্দ্ব। তাদের উৎপীড়ন ও অত্যাচারের স্বীকার হয় প্রজারা। সমাজপতিদের মধ্যে গাছ কাটা, মাছ-ধরা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, সেতু সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে কথায় কথায় চলে লাঠালাঠি, হয় মামলা-মোকদ্দমা। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে জব্দ করার জন্যে নিরস্তর ব্যস্ত। জমিদারেরা জানে আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ’ রাখতে নেই। এ জন্যে জাল, জুয়াচুরি, মিথ্যা সাক্ষ্য কোনো কিছুতেই তাঁরা পিছপা হয় না। জমিদার ও গ্রামপ্রধানদের আছে নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী। এরা যেমন নিষ্ঠুর তেমনি হীন, লোভী, স্বার্থপর। শরৎচন্দ্র এই বিবাদ-বিসংবাদকে উপন্যাসের কেন্দ্রে রেখে সমাজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।

তিনি দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশের গ্রামগুলি পারিদ্র্য, উৎপীড়ন, পরশ্রীকাতরতা, ভামি, বঞ্চনা, হতাশা, বিরোধ, কুসংস্কার, অর্থনৈতিক শোষণের নীর অন্ধকারে ডুবে আছে : প্রত্যেক গ্রামেই কৃষকদিগের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক; অনেকেরই এক ফোঁটা অমিজায়গা নাই; পরের জমিতে খাজনা দিয়া বাস করে এবং পরের শ্রমিতে জন খাটিয়া উপরানের সংস্থান করে। দুদিন কাজ না পাইলে কিংবা অসুখে-বিসুখে কাজ না করিতে পারিলেই সপরিবারে উপবাস করে।… মহাজনেরা জমি বাঁধা রাখিয়া ঋণ দেয় এবং সুদের হার এত অধিক যে একবার কোনো কৃষক সামাজিক ক্রিয়াকর্মের দায়েই হোক বা অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টির জন্যই হোক, ঋণ করিতে বাধ্য হয়, সে আর সামলাইয়া উঠিতে পারে না। প্রতি বৎসরই তাহাকে নেই মহাজনের দ্বারে গিয়া হাত পাঠিতে হয়।…

Download Now

আরও পড়ুনঃ সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মূলভাব | সংক্ষিপ্ত আলোচনা | নোট | বিষয়বস্তু

মহাজনেরা আবার হিন্দু। বেণী ঘোষালের মাধ্যমে জমিদার-মহাজনের অত্যাচারের ছবি আরো নির্মমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। মাছ বাঁচাবার জন্যে জমিদার বাঁধ কাটতে বাধা দেয়। এতে যদি চাষীর সর্বস্ব ধান নষ্ট হয়তো হোক। চাষীদের সম্পর্কে জমিদার বলে, ‘ব্যাটারা যে যার জমি বন্ধক রেখে আমাদের কাছেই টাকা ধার করতে ছুটে আসবে।…ওরা খাবে কি? ধার-কর্জ করে খাবে। নইলে আর ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন?’ এইভাবে ‘বাস্তব সামাজিক অন্যায়ের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে পল্লীসমাজ। ক্ষয়িষ্ণু সামন্তসমাজের সমস্ত বৈশিষ্ট্য এই সমাজে বিদ্যমান। নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, লোভ ও জাতিভেদ প্রথার উল্লেখ তাই এতে অস্বাভাবিক নয়, ‘ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভন্মে ঘি ঢালা একই কথা, তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া, আর ছেলেদের কাপড় একখানা করে দিলেই হত’। এই হচ্ছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি। কপটতাও এই সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। বাস্তুভিটা নীলাম থেকে বাঁচাবার জন্যে রমেশ ভৈরবকে অর্থ সাহায্য করে। কিন্তু সেই ভৈরবই পরে ষড়যন্ত্র করে রমেশকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠায়। ভৈরবের ঋণ মিথ্যা, আসামী মিথ্যা, ফরিয়াদি মিথ্যা।

ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থা যে কতটা প্রহসনমূলক আর নির্মিম ছিল, শরৎচন্দ্র তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লিখেছেন : ‘রাজার আইন, আদালত, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট সমস্ত মাথার উপর থাকিলেও দরিদ্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিঃশব্দে মরিতে হইবে’। কিন্তু শুধু গ্রামসমাজের ক্ষয়িষ্ণু চিত্র নয়, তা থেকে উত্তরণেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন শরত্চন্দ্র। তিনি দেখিয়েছেন যে, অশিক্ষাই গ্রামের মানুষের মৃঢ়তা ও কূপমণ্ডুকতার মূল কারণ। রমেশ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সমাজপতি ও জমিদারেরা তাতে বাধা দেয়। কারণ তারা জানে প্রজারা লেখাপড়া শিখে ফেললে জমিদারি রক্ষা করা যাবে না। অন্যদিকে বংশানুক্রমে প্রভাবশালীদের দ্বারা শোষিত ও শাসিত হতে হবে, সাধারণ মানুষও এটাই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যে আত্মউন্নয়ন সম্ভব, সেটা তারা ধারণা করতে পারেনি।

কেউ আবার সাহস করে এগিয়ে এলে ষড়যন্ত্র করে তার জীবন দুঃসহ করে তোলা হয়েছে। ফলে জমিদারের বিরুদ্ধে যাবার সাহস কারো হয় না। তবে শরত্চন্দ্র এখানেই থেমে যাননি। তিনি কাঁটা দিয়ে কাটা তুলবার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। জমিদারকে জমিদারের বিরুদ্ধেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষিত জমিদার রমেশ গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত গ্রহণ করে। রমেশ, বোঝা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রেনেসাঁসের আলোকিত সন্তান। সমাজ সংস্কার যার মূল লক্ষ্য। কিন্তু শিক্ষিত রমেশ একসময় আবিষ্কার করল যে, উচ্চশ্রেণী কর্তৃক শোষিত নির্যাতিত নিম্নবর্গের মানুষও প্রকৃতিতে শঠ। তারা ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরণও নয়, সাধুও নয়…নৈতিক স্বাস্থ্যও অতিশয় দূষিত’।

অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের মতে উচ্চশ্রেণীর সমাজপতিরা শোষক ও অত্যাচারীতো বটেই, নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষও নানা দোষে দোষী। রমেশ এই সমাজেরই পরিবর্তন সাধন করতে চেয়েছে। শরশ্চন্দ্র রমা-রমেশের প্রেমের মধ্য দিয়ে গ্রামসমাজের আরো কিছু দিক উন্মোচিত করেছেন। সমাজের দিকে তাকিয়েই রমা তার অন্তর্গত প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। নিজের মতামতকে সে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এই সমাজই একসময় তাকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। সমাজের কোথাও তার ঠাঁই হয়নি। বোঝা যায় শরৎচন্দ্র পল্লীসমাজ উপন্যাসে নর-নারীর প্রেমকাহিনী লিখতে চাননি। চাননি দ্বন্দ্বজটিল মনস্তত্ত্বনির্ভর মানবজীবনকে ফুটিয়ে তুলতে। তিনি প্রেম সম্পর্কিত নিজস্ব ধারণার দ্বারাই চালিত হয়েছেন। সামাজিক বিধিনিষেধ ও অনুশাসনকে রমা তাই মান্য করেছে।

আরও পড়ুনঃ শরৎচন্দ্র রচনা সমগ্র PDF | রিভিউ Rachana Samagra Rachanabali

Download Now

হুমায়ূন কবির বলেছেন, সমাজ সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের ‘সুতীব্র সচেতনতা’ ছিল বলেই তিনি নারীর এই স্বভাবজ রক্ষণশীলতা’কে এড়িয়ে যেতে পারেননি। পল্লীসমাজের রমা বা তাঁর উপন্যাসের অন্যান্য নারীচরিত্রকে তিনি ওই ভাবনার আলোকেই চিত্রিত করেছেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র প্রেমময়ী, কোমল স্বভাবের বাঙালি নারীচরিত্র অঙ্কনে যে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, ক্ষণিকের জন্যে হলেও রমার মধ্যে আমরা তার প্রতিফলন দেখি। পল্লীসমাজ যখন ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন নবম পরিচ্ছেদেই এর কাহিনী শেষ হয়ে গিয়েছিল। সমাজের ছবি তুলে ধরার ব্যাপারেই শরত্চন্দ্র উৎসাহী ছিলেন। পরে তিনি এর সঙ্গে কিছু ঘটনা যুক্ত করে রমা-রমেশের প্রেমকাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। পরবর্তী পর্বে তাই দেখা যায়, আধো পরিচিত রমণী রমার বসনাবৃত সৌন্দর্য ও প্রগলভতা রমেশকে অভিভূত করে দিয়েছে। রমার রূপে বিমুগ্ধ রমেশের চোখে লেগেছে রোমান্সের মায়ান : রমেশ যুদ্ধের মতো চাহিয়া রহিল। একি ভীষণ উদ্দাম যৌবনশ্রী! ইহার অর্দ্র বসন বিদীর্ণ করিয়া বাহিরে আসিতে চাহিতেছিল; তাহার মুখ, গঠন, প্রতি পদক্ষেপ পর্যন্ত রমেশের পরিচিত; অথচ বহুদিন-রুদ্ধ স্মৃতির কবাট কোনমতেই তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল না।

পল্লীসমাজের এই একটি অংশে শরৎচন্দ্রের চিরচেনা নারীকে খুঁজে পাই আমরা। এই নারী একই সঙ্গে মমতাময়ী, প্রিয়ের পরিচর্যায় সুখলাভকারিনী, প্রেমময়ী, নম্রস্বভাবা, মাতৃস্বরূপা, মধুরমূর্তি বিশেষ। প্রকৃতপক্ষে এই নারীভাবমূর্তিই শরৎচন্দ্রের মানসরমণী, যাকে তিনি বার বার তাঁর কথাসাহিত্যের কেন্দ্রে স্থান করে দিয়েছেন। তবে শরৎসাহিত্যের অন্যান্য নারীর মতো রমাও সামাজিক অনুশাসনকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। উল্লিখিত অংশটি ছাত্রা আর কোথাও রমেশের জন্যে রমার মধ্যে প্রেমবোধের প্রকাশ দেখা যায় না। সে পূর্বাপর রমেশের প্রবল বিরুদ্ধাচারণ করেছে।

উপন্যাসের শেষে দেখা যায় রমেশের হাতে জমিদারির স্বত্ত্ব আর যতীনের ভার তুলে দিয়ে রমা সংসার ত্যাগ করে কাশী যাত্রা করেছে। রমার চরিত্রকে শরত্চন্দ্র এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, এরকম পরিণাম ছাড়া তার অন্য কোনো পরিণাম সম্ভব ছিল না। কিন্তু যদি শরৎচন্দ্র রমার ‘অন্তগূঢ়…প্রেমের আকর্ষণলীলা’কে স্বীকার করে নিয়ে সেই প্রেমের একটা দ্বান্দ্বিক রূপ ফুটিয়ে তুলতেন, তাহলে তার চরিত্রটি শরৎসাহিত্যের উপযোগী হয়ে উঠত বলে অনেকে মনে করেন। কেননা অচরিতার্থ ট্র্যাজিক প্রেমই শরৎসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রমার মধ্যে একদিকে সমাজ এবং অন্যদিকে প্রেমাষ্পদের প্রতি দুর্দমনীয় হার্দিক আকর্ষণের টানাপোড়েন থাকলে রমা-রমেশের প্রেম আরো কিছুটা মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠত। তাদের বিচ্ছেদে সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু শরৎচন্দ্র সমাজবিরোধী কোনো দ্রোহী চরিত্র হিশেবে রমাকে গড়ে তুলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, রমা ও রমেশের মধ্যে যে প্রকাশ্য সামাজিক ও বৈষয়িক দ্বন্দ্ব, তাহাকে অতিক্রম করিয়া একটি অন্তর্ভূঢ়, প্রাণপণ চেষ্টার নিরুদ্ধ গতি, প্রেমের আকষর্ণলীলা বিপরীত স্রোতে চলিয়া যাইতেছে।’ রমা-রমেশের প্রেমের এটাই মূল বৈশিষ্ট্য।

আরও পড়ুনঃ পন্ডিতমশাই উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় PDF | Pondit Moshai

Download Now

এ-দিক থেকে বিবেচনা করলে শরত্চন্দ্রকে হয়তো রক্ষণশীল লেখক বলে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু তিনি যে সমাজের প্রকৃত ছবি তুলে ধরার ব্যাপারে বিশ্বস্ত ছিলেন, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। পল্লীসমাজেও সমাজজীবন ও সমাজচেতনাই প্রাধান্য পেয়েছে। সমাজই এখানে একটা জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। সমাজের দ্বারাই উপন্যাসের চরিত্রগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উপন্যাসের শুরুতে রমেশ ছিল কুয়াপুর সমাজে বহিরাগত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সমাজের অংশ হয়ে ওঠে। সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সমাজের বিতর্কিত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই উপন্যাসে রমেশ একই সঙ্গে সমাজকর্তৃক নিন্দিত ও নন্দিত, নিপীড়িত ও সংস্কারক, সহানুভূতিশীল ও বিরোধীও বটে। পল্লীসমাজে সমাজের গুরুত্ব এত বেশি যে, সমাজই এর নায়ক হয়ে উঠেছে। সমাজই রমেশকে সৃষ্টি করেছে।

শরৎচন্দ্র এই সমাজকে দোষারোপ করেননি। স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এর ক্ষয়িষ্ণু বিধিব্যবস্থার, অন্যায় অবিচার, নীচতা ও হীনতার। রমেশের মাধ্যমে সমাজের মৃঢ় সাধারণ মানুষের প্রতি কিছুটা খেদ ও সহানুভূতিই প্রকাশ পেয়েছে শরৎচন্দ্রের : যে বস্তু আর্তকে রক্ষা করে না, শুধু বিপন্ন করে, তাহাকেই সমাজ বলিয়া কল্পনা করার মহাপাপ তাহাদিগকে নিয়ত রসাতলের পথেই টানিয়া নামাইতেছে’। এখানে ‘তাহাদিগকে’ বলতে সমাজের অর্বাচীন কূপমণ্ডুক মানুষকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নিম্নশ্রেণী ও উচ্চশ্রেণী—সামগ্রিকভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই পচন ধরেছে। সমাজকে এ থেকে উদ্ধার করা জরুরি। শরত্চন্দ্র এজন্যে আসলে জমিদারদেরই দায়ী করেছেন। অক্রকুমার সিকদার তাই যথার্থই বলেছেন : শরৎচন্দ্রের কাছে জমিদারী মহাজনী ব্যবস্থা নয়, সমস্যার মূল তাঁর কাছে ভালো-জমিদার খারাপ-জমিদারের নমন্যা। বেণীর মতো অমিদারের অপসারণ হোক, রমার মতো জমিদারের হৃদয় পরিবর্তন হোক, গ্রামাঞ্চলে রমেশের মতো জমিদারের প্রাচুর্য দেখা দিক—তাহলেই দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষার সমস্যা মিটে যাবে। সাধারণ মানুষ তাই সমাজ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়নি। নেতৃত্ব দিয়েছে জমিদার রমেশ।

উপন্যাসের শেষে রমেশই জেল থেকে ফিরে নিম্নবর্গের মানুষের স্তরে নেমে এসে ব্রাত্যজনদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজই হয়ে উঠেছে সমস্ত চরিত্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ঔপন্যাসিক এভাবে সমাজের প্রতি গুরুত্ব দেয়ায় পল্লীসমাজের কাহিনী ঠিকমতো দানা বাঁধতে পারেনি। পল্লীর সমাজচিত্র, বিধিনিষেধ ও মানবিক দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে লেখক দীর্ঘ বর্ণনা, দীর্ঘ সংলাপ, সমালোচনামূলক রচনারীতি গ্রহণ করেছেন। এতে শিথিল হয়ে গেছে কাহিনীর গতি, ক্ষুণ্ন হয়েছে এর গল্পরস। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়তো সরাসরি বলেছেন, ‘সমাজবীক্ষায় পল্লীসমাজ উপন্যাসের ত্রুটি আছে’। তাঁর মতে কয়েকটি চরিত্রের কার্যকলাপ বা কয়েকটি ঘটনার পরিণাম দেখিয়ে সমাজের সমগ্র রূপ পাওয়া যায় না। কথাটা অনেকাংশে সত্যি।

আরও পড়ুনঃ পথের দাবী গল্পের বিষয়বস্তু PDF | Pather Dabi Summary in Bengali

শরৎসাহিত্যে একধরনের সরল ছক দেখা যায় : তত্তের সঙ্গে অমঙ্গলবোধের দ্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শুভের পরাজয় হয় এবং ট্র্যাজেডির মাধ্যমে একধরনের কারুণ্য সৃষ্টি করে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। শরৎচন্দ্র পল্লীসমাজ উপন্যাসটিকেও এই ছকের অনুবর্তী হয়ে গড়ে তুলেছেন। ফলে এতে সমাজসমস্যার অতিসরলীকরণ ঘটেছে। হুমায়ূন কবির যেমন বলেছেন, সংস্কারচেতনা এবং সামাজিক রক্ষণশীলতা দুই-ই এতে রক্ষা করা হয়েছে। তবে শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব হল, এই প্রথম বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজকে তার প্রত্যক্ষ বৈশিষ্ট্যসহ তিনি একটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু করে তুলেছেন।

রবীন্দ্রনাথে যে সমাজবাস্তবতার সূচনা হয়েছিল, শরৎচন্দ্র তাকে আরো এগিয়ে দিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করলে শরৎচন্দ্রের সাফল্য সম্পর্কে ধারণা করা আরো সহজ হবে। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন প্রধানত প্রচারবিদ, উদ্দেশ্যপ্রধান লেখক। সেকালের প্রচলিত নৈতিকতা প্রচার করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। প্রধানত রোমান্স ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি তাঁর উপন্যাসের কাহিনী গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই তুলনায় মননশীল নিরাসক্ত লেখক। পক্ষান্তরে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের আবেদন বাংলাদেশের জলবায়ুর মতোই আর্দ্র কোমল বাঙালি হৃদয়ের কাছে। তিনি তাঁর অন্তরের সমস্ত দরদ, সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও একাগ্রতা দিয়ে উপন্যাসের গল্প ও চরিত্রগুলি গড়ে তুলেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু করেছেন।

Download Now

পল্লীসমাজেও দেখি, ভ্রান্ত এবং নির্যাতিত মনুষ্যত্বের প্রতি অপরিসীম করুণা ও সহানুভূতি শরৎচন্দ্রের সমস্ত রচনার মধ্যে ফল্গুধারার মত প্রবাহিত। আজ মহাশ্বেতা দেবী, দেবেশ রায় প্রমুখের উপন্যাসে সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষের যে দেখা পাওয়া যায়, কিংবা শরত্চন্দ্রের অব্যবহিত পরে তারাশঙ্কর যে ব্রাত্যজনকে তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু করেছিলেন, কিংবা মার্কসবাদী প্রণোদনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিম্নবর্গের মানুষকে তাঁর উপন্যাসে উপজীব্য করেছিলেন, তার বীজ আসলে শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজেই রোপিত হয়ে গিয়েছিল। ঔপন্যাসিক হিশেবে শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব এইখানেই। বাঙালি উপন্যাস পাঠকের হৃদয়াসনে আজো তাই নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে তাঁর স্থান।
পৌষ ১৪০৮
মাসুদুজ্জামান
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনঃ বামুনের মেয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় PDF | রিভিউ Bamuner Meye

x
error: Content is protected !!