Skip to content
Home » আবু ইসহাকের গল্প : ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ | ৩ | আহমাদ মোস্তফা কামাল

আবু ইসহাকের গল্প : ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ | ৩ | আহমাদ মোস্তফা কামাল

আবু ইসহাকের গল্প-ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ (3)

যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

বেশকিছু গল্পে আবু ইসহাক ধর্মীয় কুসংস্কারকে তীব্রভাবে বিদ্রুপ করেছেন, যেমন কানাভুলা, প্রতিষেধক, বোম্বাই হাজি, শয়তানের ঝাড়ু, সাবীল ইত্যাদি। কিন্তু এ-ধরনের গল্পের মধ্যে দাদির নদীদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সবগুলো গল্পেই বিদ্রূপ আছে বটে, কিন্তু তা এত সূক্ষ্মভাবে, গল্পের মধ্যে এমন সুকৌশলে তা প্রবিষ্ট যে, কখনো সেগুলোকে আরোপিত বা উচ্চকিত বলে মনে হয় না, ম্যাসেজটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিছক একটি গল্পপাঠের আনন্দও পাঠকের মনে সমানভাবে জেগে থাকে।

দাদির নদীদর্শন গল্পের মৌলবি দাদি তার ষাট-বছরের জীবনে কোনোদিন নদী দেখেননি। কারণ— ‘ছহাত উঁচু দেয়াল ঘেরা এ মীরহাবেলী তাঁর বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি। তাই কৈশোরের পর তাঁকে এ দেয়ালের বাইরে যেতে হয়নি কোনোদিন। মীরহাবেলীতে মৌলবি দাদি বলে একজন আছেন, এটুকুই বাইরের লোক জানে। তারা কেউ তাঁকে কখনো চোখে দেখেনি। দেখবে কেমন করে? গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনি ভুলেও একবার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢোকেননি।… দাদির পর্দানিষ্ঠার অনেক কাহিনী উপমা হিসেবে মোল্লা-মৌলবিরা তাঁদের ওয়াজে বয়ান করে থাকেন।’ যেমন বিয়ের আগে চুল আঁচড়ানোর সময় চাচাতো ভাই তাকে দেখে ফেললে তিনি মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছিলেন । তিনি ডাক্তারি ওষুধ খান না, কারণ হারাম জিনিস ছাড়া নাকি ওষুধই হয় না।

আরও পড়ুনঃ নির্বাচিত গল্প সমগ্র | আবু ইসহাক | Nirbachito Golpo Somgro PDF

Download Now

‘ওষুধের মতো অনেক কিছুই দাদি খান না। যেমন প্যাকেট-করা বিস্কুট, কৌটোয় ভরা মাখন, লেবেল লাগানো বোতলের চাটনি, মোরব্বা, জেলি, আরো কত কী! তার মতে এগুলো বিলেতি। নাম-না-জানা চকমকে ঝলমলে নতুন কিছু হলেই সেটা বিলেতি এবং হারাম।’… ‘মীর-গৃহে গৃহবিবাদ হয়েছে অনেকবার। এই বিবাদকে দাদি বলেন জেহাদ। জেহাদ হয়েছে ছেলেদের ইংরেজি পড়া নিয়ে, গ্রামোফোন রেডিও বাজানো আর দেয়ালে ছবি টানানো নিয়ে।’ এমনকি ‘একবার মেঘের জন্যে ঈদের চাঁদ দেখা গেল না। রেডিও’র ঘোষণা শোনা গেল— বোম্বাইয়ে চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ।’ কিন্তু দাদি মানলেন না, কারণ ‘রেডু হইল শয়তানের কল, শয়তানই এই খবর দিছে ইনসানকে দাগা দিবার জন্য। মীরহাবেলীতে ঈদ হল ঈদের পরের দিন।’ এহেন দাদি যে নদী দেখবেন না সে তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু নদীই এগিয়ে এল তাকে দেখা দেবার জন্যে।

মীরহাবেলী ভেঙে গেল নদীতে। অবশেষে অন্যদের মতো দাদিকেও নতুন আশ্রয়ে যাবার জন্যে নৌকায় উঠতে হল। ভাদ্র মাস। পদ্মা অসম্ভব ফুলে উঠেছে । দুই পাড় ডুবে যাওয়ায় ধু-ধু দেখা যায় অন্য পাড়। দাদি তাঁর ঘোলাটে বুড়ো চোখ মেলে তাকান খিড়কির পর্দা ফাঁক করে। ভয় ও বিস্ময়ের ছাপ তাঁর চোখেমুখে। বলেন, এত পানি! খোদার কী কুদরত! এত পানি কোন্‌খান থিকা আসে, আবার কোথায় যায়, খোদা ছাড়া কেউ জানে না।’ এই বিপুল উত্তাল বহমান স্রোতোধারাই তার কাল হয়, দাদি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। নদী যেন এখানে বহমান-চলমান-অগ্রসর জীবনের প্রতীক, ধর্মীয় কুসংস্কারে বন্দি দাদির সঙ্গে যার দেখা হয়নি কোনোদিন। যখন দেখা হল তিনি তার ভার সইতে পারলেন না, জীবনের ইতি ঘটল তার।

আরও পড়ুনঃ সূর্য দীঘল বাড়ি | আবু ইসহাক বই রিভিউ | Surja Dighal Bari Book PDF

Download Now

প্রতীকের ব্যবহার শুধু এই গল্পেই নয়, আরও অনেক গল্পেই অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন আবু ইসহাক। তাঁর অতি বিখ্যাত গল্প জোঁক শুধু এর অসাধারণ প্রতীকময়তার কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছে বহুবছর ধরে। ভাগচাষিরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলায়, কিন্তু অর্ধেকই দিয়ে দিতে হয় মালিককে। তেমনই এক ভাগচাষি ওসমান। বুকসমান পানিতে নেমে সন্তানের স্নেহে গড়ে-তোলা পাটগাছগুলোকে কেটে তুলতে তুলতে তার শরীরে কখনো কখনো জোঁক ধরে, রক্ত চুষে পুষ্ট হয়। তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে— আহা তার মেহনতের ফসলে যদি আর কেউ ভাগ না বসাত! কিন্তু করার কিছু নেই, তার অমানুষিক পরিশ্রমের ফসলের ভাগিদার সে একা নয়, কারণ জমি তার নয়। জমির মালিক কোনো কাজ না করেই অর্ধেক নিয়ে যায়, কষ্ট হলেও এতদিন তারা সেটা মেনে আসছিল। কিন্তু ‘শিক্ষিত’ মালিক এবার নতুন ফন্দি আঁটেন, ‘তেভাগা’ আইন পাস হওয়ার সম্ভাবনায় নিরক্ষর চাষিদের কাছ থেকে টিপসই নিয়ে নেন। কী লেখা ছিল ওই কাগজে, সরল চাষিরা তা বোঝেওনি, এ নিয়ে প্রশ্নও তোলেনি।

ফসল ওঠার পর যখন তারা দেখতে পেল— মালিকের লোকজন ফসলের তিনভাগের দুইভাগ নিয়ে যাচ্ছে, তখনই কেবল প্রশ্ন জাগে এবং জানতে পারে মালিক যে তাদেরকে লাঙল-গরু কেনার জন্য টাকা দিয়েছে ওই কাগজে সেটাই লেখা ছিল, যদিও মোটেই সেটা ঘটেনি। তারা প্রতারিত হয়, অনুভব করে— জোঁকের মতোই এরাও তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে পাট তোলার সময় জোঁকের রক্ত চুষে খাওয়ার প্রতীকে এই গল্পে আবু ইসহাক এক অসামান্য কুশলতায় শ্রেণীবিভক্ত এই সমাজের শোষণের চিত্রটি এঁকেছেন।

গল্পটিতে পাটচাষের বিভিন্ন পর্যায়ের যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা আছে, সেটা একমাত্র একজন অভিজ্ঞ কৃষকের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। আবু ইসহাক কত গভীরভাবে ওই জীবনকে চিনতেন এই একটি গল্পেই তার সাক্ষ্য রয়েছে। মনে হয় ওই কৃষকের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও ডুব দিয়ে দেখেছেন পাট কাটার দৃশ্য, কিংবা কে জানে হয়তো নিজেও কেটেছেন তাদের সঙ্গে। আবু ইসহাকের দেখার অতলস্পর্শী চোখ আমাদেরকে এমনটি ভাবার জন্য প্রলুব্ধ করে।

আরও পড়ুনঃ পদ্মার পলিদ্বীপ আবু ইসহাক PDF | Poddar Poli Dip by Abu Ishak

Download Now
আহমাদ মোস্তফা কামাল 
ডিসেম্বর ২০০৫
Tags:
x
error: Content is protected !!