যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে নীলের ব্যপক চাহিদা সৃষ্টি হয়, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নীলের উৎপাদন তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বৃটিশ শাসক প্রতিনিধি নীল ব্যবসায়ীরা নীলের এই চাহিদাকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে বাংলার কৃষকদের জমিতে জোরপূর্বক নীল চাষ শুরু করে। উৎপাদিত ত্রিশ টাকার নীলে কৃষকরা ভাগ পেত পাঁচ টাকা আর ইংরেজরা পেত পঁচিশ টাকা। কোন কৃষক তার জমি নীলের জন্য দাঁদন দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে নীলকুঠিতে ধরে এনে অত্যাচারে জর্জরিত করা হত। সম্পত্তি এমনকি ঘরের মেয়েদের পর্যন্ত ধরে আনত এইসব নীলকর সাহেবেরা।
নীলদর্পণ নাটকে উড সাহেবকে নিরীহ কৃষকদের চাবুক দিয়ে প্রহার করতে দেখা যায়। উড সাহেবের মতে কৃষক মাত্রই বজ্জাত। -তুমি দেখনি, আমি বজ্জাতদের চাবুক দিয়াছি। গরু কাড়িয়া আনিয়াছি, জরু(স্ত্রী-লোক) কয়েদ করিয়াছি। জরু কয়েদ করিলে শালালোক বড় শাসিত হয়। বজ্জাতি কা বাত হাম কুচ শুনা নাই। (নীঃদঃ)
বলা হয়ে থাকে নীল দর্পণ হচ্ছে বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম গণমুখী নাটক। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত দীনবন্ধু মিত্রের এই নাটক নীল চাষের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন তৈরীতে ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল । বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র এক বিখ্যাত নাম ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার, কবি, বাংলা নাট্যজগতে প্রথম রাজনৈতিক ও বিদ্রোহমূলক নাটকের স্রষ্টা, প্রহসনকার, নাটকের মাধ্যমে গণান্দোলনের পথিকৃৎ, সামাজিক ও বাস্তবধর্মী নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ৷ তাঁর আসল নাম “গন্ধর্ব নারায়ন মিত্র” এবং তিনি ‘রায়বাহাদুর’ খ্যাতিপ্রাপ্ত হন ৷ এই নাটকটি তিনি রচনা করেছিলেন “নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিক” ছদ্মনামে।
ডাকবিভাগে কাজ করতেন দীনবন্ধু মিত্র। “নীল দর্পণ” নাটকটি যখন ছাপা হয় তখন তিনি ঢাকা বিভাগের ইনস্পেক্টিং পোস্টমাস্টার। সরকারী কাজের সুবাদে নদীয়া যশোর সহ পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় যেতে হতো তাঁকে। নীল চাষে নীল চাষিদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখা তাঁর। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলো নীল দর্পণ। পরের বছর তথা ১৮৬১ সালে ঢাকাতেই মঞ্চস্থ হলো নাটকটি।
কলকাতায় তখন পেশাদার মঞ্চ তৈরি হয়নি। নীল দর্পণ নাটক দিয়েই ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর সূচনা হয়েছিল তথাকথিত বাংলা পেশাদারি থিয়েটার ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ এর। প্রথম পেশাদারি থিয়েটার হলেও নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ ছিল না ওই দলের।
আরও পড়ুনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত | বাংলা সাহিত্যে অবদান | জীবনী
খুব সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম নিষিদ্ধ বইও হচ্ছে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ এবং এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিলো। সেটি প্রকাশিত এবং মঞ্চস্থ হবার সাথে সাথে দেশময় তুমুল আলোচনার শুরু হয়। নড়ে উঠে গোটা ভারতবর্ষের বিবেক। কাঙ্গাল হরিনাথ, কালীপ্রসন্ন সিংহ, শিশিরকুমার ঘোষেরা প্রকাশ্যে নীল চাষের বিরোধিতা করেন। যার ফলে এক ধরনের ইংরেজবিরোধীতার ঝাঁঝ পাওয়া যায় দেশময়, যা ইংরেজরাও টের না পেয়ে পারেনি। কিন্তু ইংরেজদের পক্ষে এই কিষাণদের কথ্য ভাষায় রচিত নাটকের যথাযথ রস আস্বাদন করা সম্ভব ছিলো না, তাই ইংরেজরা গিয়ে ধরলো পাদ্রী জেমস লঙকে।
কিন্তু পাদ্রী লঙ সাহেব নিজেও এর অনুবাদের কাজে খুব একটা এগুতে পারলেন না; কেননা কিষাণদের চলতি গ্রাম্য কথ্য ভাষায় লেখা এই নাটকের লক্ষ্যই ছিলো গ্রামের মানুষেরা! যা কোন ইউরোপিয়ানের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে তুলে এনে অনুবাদ করা কষ্টসাধ্য।
পাদ্রী লঙ অনুরোধের ঢেঁকী গিলে শরণাপন্ন হলেন এমন এক বাঙ্গালীর যার কিনা বাংলা বা ইংরেজী উভয়ই ভাষাতেই সাহিত্য রচনার অত্যন্ত দক্ষতা আছে। সে সময়ে এই রকম যোগ্যতার লোক বলার মতো একজনই ছিলেন, তিনি কে ছিলেন সে কথায় পরে আসছি।
নাটকের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হলো ১৮৬১ সালে; অনুবাদের বইয়ে কোন নাম নেই অনুবাদকের! পাদ্রী লঙ সাহেব নাটকের শুরুতে ভূমিকা লিখে জানালেনঃ কোন এক সুহৃদ “নেটিভ” এর বদান্যতায় এই অনুবাদ করা হয়েছে।
ইংরেজ সরকার এবার যথাযথ স্বাদ পেলো এই নাটকের, তাদের টনক নড়লো! কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে, কেননা ইংরেজী অনুবাদ হাতে রেখে ইউরোপের হরেক ভাষায় এর অনুবাদ হতে লাগলো, জনপ্রিয় হতে লাগলো আরো এই নাটক।
“নীল দর্পণ” নাটকের ভিলেনদের (নীলকরদের) এবার শরীর জ্বলে গেলো, তারা মামলাই করে বসলো; অনুবাদকের নাম পেয়ে আদালত ডেকে পাঠালেন পাদ্রী লঙ সাহেবকেই। কিন্তু তিনি আদালতে বা কোনভাবেই আসল অনুবাদকের নাম প্রকাশে রাজী হলেন না। ফলে বিচারে খোদ পাদ্রী লঙ সাহেবেরই এক হাজার টাকা জরিমানা এবং সাথে এক মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। নিষিদ্ধ করা হয় ” নীল দর্পণ “, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই নিষেধাজ্ঞা মোটেও টিকে নি!
বেচারা পাদ্রী একমাসের কারাদন্ড থেকে রেহাই পাননি ঠিকই, কিন্তু তার অর্থদন্ড আদায়ের সময় দেখা গেলো একজন “নেটিভ” তার নিজের পকেট থেকে এক হাজার টাকা অযাচিতভাবেই দিয়ে গেছেন। আর এই ব্যক্তিটি ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
আর শুরুতে যার কথা হচ্ছিল, যিনি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন তার নাম বললে চিনতেও পারেন, তিনি একসময়কার wanna be ইংরেজি সাহিত্যিক মাইকেল মধুসূদন দত্ত!