যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
বইয়ের নামঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল
লেখকঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বইয়ের ধরনঃ উপন্যাস
প্রকাশনাঃ সূর্যোদয় প্রকাশন
প্রথম প্রকাশকালঃ জুলাই, ২০২১
প্রচ্ছদঃ এমএ আরিফ
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৭৫
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা
রিভিউ করেছেনঃ Mohammad Yiasin Arafat
সদ্য পড়া শেষ করেছি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘৪০ এর দশকে লিখা কালজয়ী উপন্যাস ‘আদর্শ হিন্দু-হোটেল।’ ‘মাতাল হাওয়া‘ রিভিউ লিখার পর যে পজিটিভ সাড়াশব্দ এবং উৎসাহ পেয়েছি তাতে এই সুপরিচিত বিখ্যাত বইটির রিভিউ লিখতে কিঞ্চিত সাহসিকতা সঞ্চার করে বসে পড়লাম।
প্রথমে বলে রাখি, বইটি অবশ্যই সুখপাঠ্য ও চিত্তাকর্ষক। পাঠক একবার পড়া শুরু করলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়ার সংকল্প করতে বাধ্য। তবে বইটি সাধুরীতিতে লিখিত হওয়ায় আমার একটু জটিল লেগেছে। তৎকালীন সমাজের কিছু বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতায় ভোগায় তার পাঠোদ্ধার দুর্বোধ্য ঠেকেছে। বাকি সব ঠিকঠাক। রিভিউ দিতে গিয়ে যাতে স্পয়লার দিয়ে না দিই সেদিকেও দৃষ্টি রেখেছি। যাক মূল কথায় আসি—
বইটি পড়ার শুরুতে যে জিনিসটা মনের অজান্তে হৃদয়ে সুন্দর প্রতিচ্ছবি আঁকবে তা হচ্ছে লেখকের সুস্পষ্ট বাচনভঙ্গি এবং ঘটনার পর ঘটনা সাজাঁনোর অভূতপূর্ব সমাহার। উপন্যাসটি মূলত হাজারি ঠাকুরের রাধুনি থেকে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠার অসাধারণ গল্প। তৎকালীন ‘৪০ এর দশকের সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানান আবহে উপন্যাসটির স্বার্থকতার মাত্রা লাভ করেছে।
উপন্যাসের শুরুটা হয় এভাবে, ‘রাণাঘাটের রেল-বাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেল যে রাণাঘাটের আদি ও অকৃত্রিম হিন্দু-হোটেল এ-কথা হোটেলের সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা না থাকিলেও অনেকেই জানে।’ এই জানার কারণ একজনই। তার নাম হাজারি। পেশায় বাঙালি রসুই বামুন হলেও তার চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের সৎ, বিবেকবান ও সহানুভূতিশীল মানুষের পরিস্ফুটন অস্ফুটস্বরে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হলেও প্রতিবাদে সে দৃঢ়চেতা। কর্মক্ষেত্রে হাজার ষড়যন্ত্র এবং গালিগালাজের মধ্য দিয়ে গেলেও তার নীরবতা, সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে তার লালিত স্বপ্নে বিভোর থাকা এবং মনের মধ্যে হোটেল দেয়ার তীব্র ইচ্ছার বীজ বপন- সবকিছুই দেখা যায় তার চরিত্রে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে উপন্যাসের হরিচরণ বাবুর এই ভাষ্যে, ‘এই দেখ তোমার বয়সে আর আমার বয়সে খুব বেশী তফাৎ হবে না। তোমারও প্রায় পঞ্চাশ হয়েছে-না হয় এক-আধ বছর বাকি। কিন্তু তোমার জীবনে উদ্যম আছে, আশা আছে, মনে তুমি এখনও যুবক।’ তার স্বপ্নের আঙ্গিকে নিজস্ব হোটেল খোলার এই উদ্যমতা, আশা তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ, মানুষ যে তার স্বপ্নের সমান বড় তার প্রকৃষ্ট প্রমান লেখক দেখিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনী | Durgesh Nandini PDF
গল্পে অন্যতম এক চরিত্র ‘পদ্ধ ঝি’। সে শঠতা, জোচ্চোর, বিষাক্ততা, আত্ম অহমিকায় বলীয়ান নারীর প্রতিনিধি যাকে দিয়ে লেখক হয়তো তার সমকালীন সময়ের ‘ধূর্ততার-প্রতীক’ হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন এবং বর্তমানকালেও যাদের আবেদন একটুও ফুরাই না। তারা ছিল, আছে এবং থাকবে। অহংকার যে পতনের মূল তা লেখক তার সুন্দর শব্দরাজি বর্ষণ করে গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন এই চরিত্র চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে।
উপন্যাসে হাজারির স্ত্রীর উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা দেখা না গেলেও তার মধ্যে ধৈর্যশীল, স্বামীর অনুগত থাকা ও সংসার সামাল দেয়া এক গ্রাম্য গৃহ বধূর পরিচয় পাওয়া যায়। সংসারের বিরাট বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে পালনের মধ্য দিয়ে সমাজে গৃহস্থ নারীদের ভূমিকাও যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম না তা অবলোকন করা যায়।
সমাজের বিপরীতে গিয়ে কর্তৃরাও যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পটু তা দুই বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন। তাদের একজন গোয়ালা কন্যা ‘কুসুম’। সম্ভাবনাময় একজন ব্যক্তির (হাজারি) উপর আমূল ভরসা করে নিজের শেষ সম্বলটুকু কোনো শর্ত ছাড়াই উজাড় করে দেয়া, আপন মেয়ে না হয়েও বাবা সমতুল্য একজন প্রতিবেশীকে পিতৃতুল্যে জ্ঞান করা এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ সবকিছুই লেখক সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত করেছেন৷
তাছাড়া আছে জমিদার বাড়ির শিক্ষিত দরদী কন্যা ‘অতসী’। তাদের উভয়ের বিশ্বাস, ভরসা, শ্রদ্ধার সাথে সাথে হাজারিকে নিঃশর্তে হোটেল খোলার টাকা দেওয়ার অভূতপূর্ব ঘটনা এবং এতে সমাজে নারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। নজরুল আগেই বলে গিয়েছেন,
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
লেখক তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত যুবকের বেকার থাকার চিত্রও অংকন করেছেন নিপুণভাবে। শিক্ষিত যুবকের কোথাও চাকরি না মেলা তার সাথে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত থাকার বিষয়টিও লেখকের চোখ এড়ায়নি। গল্পে সেরকম একজন যুবক ‘নরেন’। যে ইংরেজি, বাংলা দুই-ই জানে। তার দক্ষতাকে লেখক হেয় করে দেখান নি। পরবর্তীতে তার স্বচ্ছলতা ফিরে আসার দৃশ্যপটও লেখক দেখিয়েছেন হাজারির কন্যা আশালতা (টেঁপি) কে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, জীবনের কোনো শিক্ষা বৃথা ফলেনা।
উপন্যাসের সারসংক্ষেপঃ
হাজারির বয়স ছেচল্লিশের কৌটায়। প্রতি মাসে সাত টাকার বিনিময়ে এক হোটেলে কাজ করে যার মালিক ‘বেচু চক্কত্তি’। ‘পদ্ম ঝি’ (ঝি হওয়া সত্ত্বেও ষোলা আনা ক্ষমতা তার হাতে) যাকে হাজারি পদ্মদিদি বলে সম্বোধন করে সে তার উপর ঈর্ষার বশীভূত হয়ে নানারকম অপবাদ এবং অত্যাচার চালায়। সবকিছু বাদ দিয়ে নিয়মমতো প্রতিদিন দুপুরে অবসরে চলে যান চূর্ণি নদীর ঘাটে। নিত্য অবসরে তার উৎসুক মনে নতুন হোটেল খোলার স্বপ্ন উঁকি দিতে থাকে। অবশেষে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছায়।
আরও পড়ুনঃ ইন্দুবালা ভাতের হোটেল PDF রিভিউ | কল্লোল লাহিড়ী
বইয়ের প্রেক্ষাপটঃ
আদর্শ হিন্দু হোটেল ইংরেজ আমলের ব্রাহ্মণ সমাজের একজন রাধুনি বামুণ হাজারী দেবশর্মার জীবনকাহিনী অবলম্বনে রচিত উপন্যাস। যেখানে হাজারী দেবশর্মা অপরের হোটেলের রাধুনী থেকে নিজের হোটেল তৈরির প্রচেষ্টা, উদ্যম, বাস্তবায়ন ও সফলতার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
বইয়ের সারসংক্ষেপঃ
রাণাঘাটের রেলবাজারের বেচু চক্কত্তির বিখ্যাত হিন্দু হোটেলের রাধুনি ছিলেন হাজারী ঠাকুর। মাসিক সাত টাকা ও দুবেলা আহারসহ হোটেলে রাত্রি যাপনের সুযোগের পাশাপাশি হোটেলের পদ্নঝির উপদ্রবও সহ্য করতে হতো।হাজারী ঠাকুরের হাতের রান্না কেউ একবার খেলে আবারও খাওয়ার জন্য হোটেলে আসতো; যার কারণে বেচু চক্কত্তির হোটেলের সুনাম ছিল বেশ। তবে পদ্নঝি হাজারী ঠাকুরকে মোটেও দেখতে পেত না এমনকি একবার চুরির দায়ে হাজারি ঠাকুরকে জেলে পাঠিয়েছিলো অবশ্য পরবর্তীতে যখন দেখে হাজারী ঠাকুর ছাড়া হোটেল ভালো চলছে না তখন আবারও তাকে হোটেলে বহাল রাখে।
দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় বেচু চক্কত্তির হোটেলে কাজ করলেও হাজারী ঠাকুর সবসময় ভাবতো নিজের একটা হোটেল তৈরি করবে যেখানে সব কিছু অনেক নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলবে। রাণাঘাটে হাজারী ঠাকুরের এক ধর্ম মেয়ে কুসুম, তার গ্রাম এঁড়োশোলাতে গেলে সেখানে তার মেয়ে টেঁপির বান্ধবী অতসী, নতুন পাড়ার গোয়ালা বাড়ির বৌ সকলেই হাজারী ঠাকুরকে নতুন হোটেল খোলার জন্য সাহায্য করতে চেয়েছিল। হাজারী ঠাকুরের মতো সৎ, কর্মঠ ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ করতো।
এতোগুলো মানুষের সহযোগিতা, বিশ্বাস, নিজের ইচ্ছাশক্তির বলে হাজারী ঠাকুর রাণাঘাটের রেলবাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেলের পাশেই হোটেল খোলে যার নাম দেয় “আদর্শ হিন্দু হোটেল”। পরবর্তীতে হাজারী ঠাকুর দুটি হোটেলের মালিক হয় এবং মোম্বে যাওয়ারও সুযোগ পায়। হোটেল দুটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালানো, তার স্ত্রী সন্তানদেরকে শহরে নিয়ে এসে সুন্দর জীবন দেওয়া, কুসুমকে সাহায্য করা, টেঁপিকে নরেন এর সাথে বিবাহ দেওয়া, রেলবাজারের সুনাম অর্জন করা এমনকি যখন তার আগের মনিব বেচু চক্কত্তির হোটেল বিক্রি হয়ে যায় তখন তিনি তার মনিব ও পদ্নঝিকে তার হোটেলে কাজ দেওয়া সবাই তার সৌভাগ্য ছিল। কিন্তু মোম্বে যাওয়ার আগে পদ্নঝি যখন হাজারী ঠাকুরের পায়ের ধুলো নেয় তখন হাজারী ঠাকুরের এই সৌভাগ্য সকল সৌভাগ্যকে ছাড়ায়ে যায়।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
জীবনের কোন কিছু করার লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, পাশে যদি সহযোগিতার কিছু মানুষ থাকে এবং কাজে যদি সৎ থাকা যায় তাহলে যে কোনো অসাধ্য কাজও সাধ্য করা যায়, হাজারী ঠাকুরের কর্মজীবন তারই প্রতিফলন।
রিভিউ করেছেনঃ Munzeera Eshita
আরও পড়ুনঃ আরণ্যক PDF | উপন্যাসের বিষয়বস্তু | রিভিউ | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়