Skip to content
Home » পুতুল নাচের ইতিকথা রিভিউ PDF | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস সমালোচনা

পুতুল নাচের ইতিকথা রিভিউ PDF | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস সমালোচনা

পুতুল নাচের ইতিকথা রিভিউ PDF Download মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস

যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

বইঃ পুতুল নাচের ইতিকথা
লেখকঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ইতিকথা ট্রিলজির প্রথম পর্ব “পুতুল নাচের ইতিকথা”। পরবর্তী পর্বগুলো যথাক্রমে “শহরবাসের ইতিকথা” এবং “ইতিকথার পরের কথা“। বাকি দুটি বইও পড়ে নিতে ভুলবেন না।

মানিকবাবুর লেখা “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসটি নিশ্চয়ই একাডেমিক লাইফে পড়ে এসেছেন। যেটা নিয়ে এখনো সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ব্যঙ্গচিত্র দেখা যায়। কুবের এবং কপিলাকে নিয়ে তৈরি মিমগুলো বেশি জনপ্রিয়। যাইহোক, শিক্ষাজীবনে যারা মানিকবাবুকে পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন উনার লেখার গভীরতা কত।

Download Now

প্রাইমারি হেডটিচার আমার নানু বলতেন, মানিক বাবু খুব শক্তিমান লেখক। আমি ভাবতাম, মানিক বাবু হয়ত অনেক পেশিবহুল লম্বাচওড়া কোন লোক। সিনেমার নায়কের মত যে একাই একশজনকে শুইয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি যে পেশিশক্তি নয় সেটা বুঝার ক্ষমতা হয়েছে অনেক পরে।

তখন আমি খুব ছোট। পুতুলজাতীয় কোন আলোচনা মানেই আমাদের ধারনা ছিলো এটা মেয়েলি বিষয়। আর মেয়েলি কোন টাচ আছে এমন জিনিসের কথা চিন্তা করাও সে সময়ে আমাদের জন্য নিষেধ ছিলো।

সে সময় গ্রামে গ্রামে ছোটছোট মেলা হতো। যখন যে গ্রামে মেলা হতো আশপাশের তেরো গ্রাম পর্যন্ত উৎসব ছড়িয়ে থাকতো। আর আমি শুধু খুজে বেড়াতাম মেলার কোন অংশে পুতুল নাচের আসর বসেছে। শক্তিমান মানিক বাবুকে দেখবো বলে।

Download Now

আশ্চর্যের বিষই এই জীবনে ফাল্গুনী পাঠকের গানের ভিডিও ছাড়া আর কোথাও কোন পুতুল নাচ দেখা হয়নি আমার। (তুনে চুনরি কিও লেহরায়ি, ওওওও ওও..)

কিন্তু এই বইটা পড়ার পর আমি বুঝেছি পুতুলনাচ দেখা হয়নি, আমার এ ধারনা মিথ্যা, বানোয়াট, কল্পনাপ্রসূত। প্রতিনিয়ত পুতুল আর তার নাচের মধ্যেই ঘিরে আছি।

আরও পড়ুনঃ পিডিএফ বলতে কি বুঝায় ? এর কাজ কি ? বাংলা পিডিএফ বই ফ্রি ডাউনলোড

মানুষ খুবই গোঁজামিল দেওয়া জাতী। নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য সে নিজের আদলে খেলনা বানায়। মানুষকে নিয়ে যেমন যথেচ্ছা খেলা হচ্ছে। ঠিক সেরকম করে খেলনা দিয়ে খেলে ফেইক আত্মতুষ্টিকে ভোগে। নিজের লজ্জা লুকিয়ে রাখার অসম্ভব চেষ্টা করে যায় সব সময়।

Download Now

বইটা পড়ার পর এই বিশাল পৃথিবীর অসংখ্য পুতুল নাচ প্রতিদিন দেখার তুষ্টি অথবা বেদনা আমাকে ঘিরে ধরে। আমি জানতে পারি মানিক বাবুর শক্তিমত্তা সম্পর্কে। শুধু একশত নয়! কোটিকোটি মানুষকে আঙ্গুলের ইশারায় শুইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তার।

আরও পড়ুনঃ ইতিকথার পরের কথা রিভিউ PDF | Itikathar Porer Katha Download

পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসটিতে অতি ছোট একটা প্লট। অযথা ঝকমকি নাই, নাই বাড়তি আস্ফালন। আপনার আমার হয়ত শশী-কুমুদ, মতি-কুসুম বা গোপালদের এই ঘটনাগুলো বিশেষভাবে চোখে পড়ার মত মনেই হতো না কখনো। কিন্তু রোজকার ডালভাত এই ঘটনা গুলোর মধ্যে যে এমন বিশেষ কিছু থাকতে পারে, থাকতে পারে এত মাদকতা তা মানিক বাবু দেখিয়েছেন।

গল্পটা আসলে মনস্তাত্ত্বিক। মানুষের মনের ভেতর ঢুকে তার নিজের সাথে যে আলোচনা। তার ক্ষনেক্ষনে বদলে যাওয়া যে রুপ, সেটার স্বার্থক বর্ণনা।

Download Now

বইটা বিভিন্ন মানষিক অবস্থায় আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ দিবে। আপনি যদি বর্তমানে খুবই মানসিক প্রেশারে থাকেন। আপনার চারদিকের পৃথিবী আপনার উপর সংকীর্ণ হয়ে আসতে থাকে, তবে বইটা এই মূহুর্তে আপনার জন্যই খুবই দরকারি। বইটা পড়ার পরে আপনার অনেক জট খুলে যাবে।

আরও পড়ুনঃ এইসব দিনরাত্রি হুমায়ুন আহমেদ উপন্যাস রিভিউ | Eisob Dinratri Book PDF

একটা বীজ রুপনের পর ধিরে ধিরে যেভাবে গাছ হয়ে উঠে, গল্পটাও ঠিক সেভাবেই অতি ধীরে জন্ম থেকে আপনাকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবে। আপনি লক্ষ্য করবেন গল্পটা আস্তে আস্তে আপনার পা, হাঁটু, কোমর, বুক, গলা, নাক, মুখ, চোখ, মাথা হয়ে পুরো আপনিটাকেই গ্রাস করে ফেলেছে।

আপনি দেখতে পাবেন, একজন লেখক যখন প্রকৃতই লেখক হয় তখন তাকে বিভিন্ন জিনিসের আড়ালে আশ্রয় নিতে হয়না। না ধর্ম, না সমাজ, না বিভিন্ন ম্যাটাফোর, বা অন্যকোন লেখকের স্টাইলের আড়ালে আশ্রয়।

লেখকরা সব সময়েই সমাজের অসংগতি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন তাদের গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে। সমাজের যে কুসংস্কার গোড়ামি ছিলো বা যা কিছু ক্ষতিকর তার বিরুদ্ধেই লেখার মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একজনের লেখার আলোচনা করতে গিয়ে অন্যকারো সমালোচনা করা ঠিকনা। কিন্তু জিনিসটা প্রাসঙ্গিক তাই বলতে হচ্ছে –

এখনকার লেখকরা অনুকরণ করেন। অনেকে বড় বড় লেখকদের লেখা সরাসরি কপিও মেরে নিজের বলে চালিয়ে দেন। তা করুন, যার যা ইচ্ছা করবে কি আর বলার আছে। কিন্তু বর্তমান লেখকরা আপডেট হচ্ছেন না কেন বুঝিনা!

Download Now

অনুকরণ করতে গিয়ে সেই একই রকম ভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, যে কোন নিয়মশৃঙ্খলা ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা। অনিয়মই সবচেয়ে বড় নিয়ম তা মেনে লেখালেখি করা এগুলাই কেন করে যাচ্ছেন! তাদের কি চোখ নাই? নাকি তারা দেখেন না! সমাজ বদলেছে। এখন প্রতিবাদের ধরন ও বদলানো উচিত। খারাপ শৃঙ্খল ভাঙতে ভাঙতে ভালো শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাও যে ধ্বংসের মুখে এটা যদি লেখকরা না বুঝেন ত বুঝবে কোন চ্যাটের বাল।

আরও পড়ুনঃ আরেক ফাল্গুন পিডিএফ জহির রায়হান উপন্যাস রিভিউ | PDF

মানুষের মধ্যে যে কি ভিষণ হাহাকার প্রতিনিয়ত। অশান্তির এই যে মহোৎসব হচ্ছে চারদিকে তার কারণ কি চোখে পড়ে না বর্তমান লেখকদের? হুমায়ুন আহমেদ কপি করে, ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের ছবির ক্যাপশন হতে পারে এমন কিছু নিজস্ব লাইন লিখে একটা বই লিখে ফেলতে লজ্জা করেনা?

সমাজের সংস্কার, সমাজের দুঃখ কষ্ট, মানুষের মন এগুলা নিয়ে যদি নাই ভাবতে পারে তাহলে নিজেকে লেখক ভাবার আগে নিজের গালে জুতা মারেনা কেন। ঝুলে পড়েনা কেন গাছের ডালে?

Download Now

মুরাকামির নরোজিয়ান উডসে নাগাসাওয়া একটা কথা বলেছিলো, যে লেখক মারা গেছেন অন্তত ৩০ বছর আগে তার বই ছাড়া অন্যদের বই সে পড়ে না। মাঝেমাঝে আমার মনেহয় বর্তমান সব পাঠকদের এই কাজই করা উচিত। ভালো মানের সাহিত্য ত পড়াই হবে, উপরি হিসেবে নিলজ্জ্ব ভাবে নিজেকে লেখক হিসেবে দাবি করা এসব কিটদের থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। 

আরও পড়ুনঃ রিক্তের বেদন গল্পের বিষয়বস্তু | রিভিউ | PDF | কাজী নজরুল ইসলাম

কিন্তু আমি পার্সনালি নতুনদের লেখা পড়ার পক্ষপাতি। লেখা না পড়লে বই বিক্রি না হলে অনুপ্রেরণা পাবে কোথায়! কিন্তু প্রতি বই মেলায় নতুনদের বই কিনি আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করি হুমায়ূন আহমেদ মরে গিয়েও কিরকম করে বেঁচে আছেন এদের মাথায়। কোন অন্তঃদৃষ্টি নাই। কোন সাহসী একটা কথা নাই। নাই কোন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

পুতুল নাচ পড়ে আবার বুঝতে পারলাম সৃষ্টি কি জিনিস। স্রষ্টা হওয়াটা এত সহজ কোন বিষয়না। গভীর তপস্যা অফুরন্ত সাহস, সমাজ বা মানুষের জন্য ভালো করার নিঃস্বার্থ চেষ্টা কাওকে কোন সৃষ্টির স্রষ্টা হতে সাহায্য করে।

বারবার ফিরে আসুক পুতুল নাচের ইতিকথা এর মত বই। বারবার ফিরে আসুন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। হাজার বছর ধরে ফিরে আসুন প্রকৃত লেখক, কবি। সমাজ, মানুষ, মানুষের মন নিয়ে ভাবার মত সাহিত্যিক।

রিভিউ করেছেনঃ আরিফ বাবু

Download Now

আরও পড়ুনঃ পরিণীতা উপন্যাস রিভিউ PDF Download | শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মানিক অথবা মানিকের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’

খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল । আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।

আমার চেনাপরিচিতের মধ্যে, এ বাক্যদুটির তাৎপর্য না বুঝতে পেরে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন এমন পাঠকের অভাব নেই । নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট মগ্ন পাঠক । বেশিরভাগেরই প্রশ্ন হবে ‘কটাক্ষ করা’ মানে মৃত্যু কী করে হয়?

আমি যখন ছেড়ে দিই ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, তখন অবশ্য এ অংশের অসংলগ্ন এবং অযাচিত দীর্ঘায়নকে দায়ী করেছিলাম। তখনও আমি মানিকে মজিনি। এমনকি ‘পদ্মানদীর মাঝি’ও তখন বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেওয়া পাঠকের দলে আমি। মানিক পড়তে গেলে সত্যি সত্যিই পরিষ্কার মগজ দরকার। এই হিসেবটা মাথায় রেখেই সবসময় মানিক পড়তে বসার জন্য বলবো সকলকে।

পাঠক মনস্তত্ত্ব নিয়ে যখন শুরু করেছি, আরেকটু বলি তবে। কী করে কী করে যেন পাঠক প্রেম আর যৌনতাতেই বশ, যেকোনো ফিকশনের। যত রকমের, যত সকমের তত্ত্বজ্ঞান থাকুক না কেন খুঁজে বের করতেই হবে উল্টেপাল্টে

Download Now

শরীর! শরীর!

‘তোমার মন নাই কুসুম?’

শশীর এই দিকটি পরে এসেছে অনেক। তাকে যে গ্রাম্য ডাক্তার হিসেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই লিখেছেন মানিক, সেকথা স্বীকার করেছেন তাঁরই ‘উপন্যাসের ধারা’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন—

‘লিখতে শুরু করেই আমার উপন্যাস লেখার দিকে ঝোঁক পড়লো। কয়েকটি গল্প লেখার পরেই গ্রাম্য এক ডাক্তারকে নিয়ে আরেকটি গল্প ফাঁদতে বসে কল্পনায় ভিড় করে এল ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র উপকরণ এবং কয়েকদিনে একটি গল্প লিখে ফেলার বদলে দীর্ঘদিন ধরে লিখলাম এই দীর্ঘ উপন্যাস— এ ব্যাপারের সঙ্গে সাধ করে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার সম্পর্ক অনেকদিন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। মোটামুটি একটা ধারণা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, সাহিত্যিকেরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে বর্তমান যুগে, কারণ তাতে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের অনেক চোরা মোহের স্বরূপ চিনে সেগুলো কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়।’

আরও পড়ুনঃ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনী | ১ম পর্ব | সম্পূর্ণ জীবন কাহিনী | Sukanta

ড. সরোজমোহন মিত্র মন্তব্য করেছেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ রচনাকালেও মানিক এই সমস্ত চোরা মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যুক্তি দিয়েছেন এ উপন্যাসেই একাধিক জায়গায় অজানা শক্তির অস্তিত্বের কথা মানিক প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন। না-ই যদি করতেন, কুসুমের বাবাকে দিয়ে বলাতেন না—

‘ছোট মেয়ে, বড় দু’বোনের বিয়ের পর ওই ছিল কাছে, বড় আদরে মানুষ হয়েছিল— একটু তাই খেয়ালী হয়েছে প্রকৃতি। সবচেয়ে ভাল ঘর-বর দেখে বিয়ে দিলাম, ওর অদেষ্টেই হ’ল কষ্ট। সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বৈ তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’

আবার ‘তাকে একবার হাতে পেলে দেখে নিতাম।’— শশীর এই জবাবে যতই অধ্যাত্মবাদবিরোধিতা থাকুক, তা বরং ঈশ্বরবাদিতার প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তিই। সেদিক দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তায় স্ববিরোধী ভাবধারার প্রশ্ন উঠতে পারে। এর সমাধানও বোধকরি ড. মিত্রের মূল্যায়ন—

আসলে মানিক তখনো নিজের পথ খুঁজে পান নি। তাঁর নিজস্ব ‘জীবন-দর্শন’ তখনো ঠিক গড়ে ওঠেনি।

একথা সত্য— এই অজানা শক্তির অস্তিত্বের প্রসঙ্গেই স্মিত হাসছে নিয়তিচেতনা। সমগ্র উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়তিচেতনার প্রবাহই প্রধান বলে প্রতীয়মান। সেই যে হারু ঘোষের মৃত্যুতে নিয়তিচেতনার আত্মপ্রকাশ, মতি-কুমুদের প্রেম হয়ে শশী-কুসুমের বিচ্ছেদ পর্যন্ত তার অবাধ বিচরণ।

কে ভেবেছিল হারু ঘোষ মতির পাত্র খুঁজতে গিয়ে আর ফিরবেন না? ফেরেননি বলেই ত মতির গতি একরকম শশীর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। শশী তাকে বিয়ে করবে কি না। কুমুদের সাথে মতির প্রেমও, তাই বলা যায় হারু ঘোষের মৃত্যুর সুতোয় বাঁধা। সবশেষে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় শশীর নিঃস্বতাই বুঝি নিয়তিচেতনার চূড়ান্ত প্রয়োগ।

Download Now

এই অবস্থাতেই শশী চরিত্রকে তৈরি করতে চেয়েছেন একনিষ্ঠরকমের আধুনিক মনন দিয়ে। তার স্থানে স্থানে কীসের যেন ফাঁক থেকে গেছে। একই শশী ছ্যুৎমার্গ বিচার করে আবার অস্বীকারও করে। মানিক লিখেছেন—

শ্যাওড়া গাছের একটা ডাল ধরিয়া ফেলিয়া নৌকা স্থির করিয়া গোবর্ধন বলিল, ‘আপনি লায়ে বসবে এস বাবু, আমি লাবাচ্ছি।’

শশী বলিল, ‘দূর হতভাগা, তোকে ছুঁতে নেই।’

গোবর্ধন বলিল ছুঁলাম বা, কে জানছে? আপনি ও ধুমসো মড়াটাকে লাবাতে পারবে কেন?

শশী ভাবিয়া দেখিল কথাটা মিথ্যা নয়। পড়িয়া গেলে হারুর সর্বাঙ্গ কাদামাখা হইয়া যাইবে। তার চেয়ে গোবর্ধন ছুঁইলে শবের আর এমন কি বেশি অপমান? অপঘাতে মৃত্যু হইয়াছে— মুক্তি হারুর গোবর্ধন ছুঁইলেও নাই, না ছুঁইলেও নাই।

শশীর চরিত্রগত ত্রুটি বোধকরি গ্রামের সন্তান হয়ে গ্রামবিমুখতা। সেদিক বিবেচনায় কিছুটা হলেও সে নেতিবাচক বিশেষত্বের নায়ক চরিত্র। গ্রামের ব্যাপারে শশীর মূল্যায়ন এভাবে এসেছে উপন্যাসে—

তারপর গ্রামে ডাক্তারি করিতে বসিয়া প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল। জীবনটা কলিকাতায় যেন বন্ধুর বিবাহের বাজনার মতো বাজিতেছিল, সহসা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। এইসব অশিক্ষিত নরনারী, ডোবা পুকুর, বনজঙ্গল, মাঠ, বাকি জীবনটা তাহাকে এখানেই কাটাইতে হইবে নাকি? ও ভগবান, একটা লাইব্রেরি পর্যন্ত যে এখানে নাই!

এমন ভাবনা অবশ্য চিরকাল শশীর থাকেনি। তাতেও মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে গ্রামীণ সাদামাটা জীবনের ব্যাপারে উষ্মা। আবার এই শশীই গ্রামের একাধিক রোগীর বাঁধা ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। একথা সত্য— দিনশেষে শশী গ্রামের জীবন প্রসঙ্গে মিশ্র চিন্তাধারা লালন করেছে। সে কারণে যতটা দেওয়ার গ্রামকে, ততটা ঠিক দিয়ে ওঠা হয়নি তার পক্ষে।

আরও পড়ুনঃ কপালকুণ্ডলা বাংলা বই রিভিউ উপন্যাসের সারাংশ | Kapalkundala PDF

আলোচনার এ পর্যায়ে দুটো সত্য স্বীকার্য। এক— মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখক মনের আর হাতে ধরা কলমের, দুই বিপ্রতীপ স্রোতকে শশী চরিত্রে মিশিয়ে গাওদিয়া গ্রামে এনে মিলিয়েছেন। দুই— শশীর বাবা গোপালের যত দুর্নামই থাকুক গ্রামে, গ্রামের মানুষগুলোর কথা সে ভাবে বটে। নইলে শশীকে গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার ব্যাপারে কেন বোঝাতে বসবেন তিনি?

শশীকে সৃষ্টির বীজমন্ত্র বোধহয় আরও কিছুটা আগেই কাগজে কলমে লিখছিলেন মানিক। তাঁর নিজস্ব বক্তব্য ত আগেই লিখেছি এ আলোচনায়। তার বাইরেও কথা আছে।

Download Now

মানিকের লেখায় গ্রাম্য ডাক্তার জরুরি চরিত্র। ‘জননী’ উপন্যাসে হারান ডাক্তার। একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র। সেখানে মানিক লিখেছেন—

জীবন-মরণের ভার যে ডাক্তার পান চিবাইতে চিবাইতে লইতে পারে সে-ই তো ডাক্তার।

এখানে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে। একই ধারায় শুধু গ্রাম্য ডাক্তার ধরে লিখবেন, হতে পারে এই মানসে শশীকে ভাবা। সেই সময়ই যখন তাঁর মাথায় যাত্রাদলের গল্প এলো তখন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র সৃষ্টি।

প্রেমিক শশীর ব্যক্তিত্ব বোধকরি হেরম্বের ব্যক্তিত্বের বিবর্ধিত সংস্করণ। এ ধারণা এজন্য করছি যে এই দুটোই মূলত মানিকের সাহিত্যজীবনের শুরুর (ত্রিশের) দশকের গল্প ভাবনায় নির্মিত উপন্যাস। এটা তর্ক‌যোগ্যভাবে ধরে নেওয়া যায় যে হেরম্বের ব্যক্তিত্বের বিস্তারিত প্রয়োগ হয়েছে শশী চরিত্রের নির্মাণে। মূলত ‘জননী’র হারান আর ‘দিবারাত্রির কাব্য’র হেরম্বকে গড়েপিটে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় শশী বানিয়ে থাকতে পারেন মানিক।

সেজন্য শশী-কুসুমকে হেরম্ব-সুপ্রিয়ার পাশাপাশি রেখে আলোচনা করার সুযোগকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সুপ্রিয়ার কাছে হেরম্বের ফিরে যাওয়া না যাওয়ার উন্মুক্ত পথের দিশা কিছুটা হলেও পাওয়া গেছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য়। সে কারণেই যেখানে সুপ্রিয়া হেরম্বকে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে ওঠেনি, সেখানে কুসুম বলতে ছাড়েনি—

Download Now

‘আপনাকে কি বলব ছোটবাবু, আপনি এত বোঝেন। লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আসতে আসতে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? … কাকে ডাকছেন ছোটবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।’

এখানে এসে বোধকরি কুসুম শশীর প্রশ্নের উত্তরটাই দিয়ে দিল—

শরীর! শরীর!

‘তোমার মন নাই কুসুম?’

এ ত বাঙালি নারীর চিরায়ত যৌনবঞ্চনার আক্ষেপের প্রতিচ্ছবি। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসে মালতীর সংলাপে একটু অন্যভাবে একই কথা এসেছে—

‘চুপ! একটি কথা নয়।’— মালতী টেনে টেনে হাসল, ‘তুমি বোঝ ছাই, বলবেও ছাই। দেড় যুগ আঙুল দিয়ে ছোঁয় না, তাই বলে আমি কি মরে আছি? বুড়ো হয়ে গেলাম, শখ-টখ আমার আর নেই বাপু, এখন ধম্মোকম্মো সার। ঠাট্টা-তামাশা করি একটু, মিনসে তাও বোঝে না।’

তিন নারী সুপ্রিয়া, মালতী, আনন্দ— কারোরই হয়ে উঠতে না পারার পরিণতির সাথে শশী-কুসুমের বিচ্ছেদের পরিণতির সুর মিলে যেতে চায়।

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদে যাত্রাপালার যে স্বল্প বিবরণ মানিক দিয়েছেন, সেখানে সেকালের সমাজে যাত্রার আবেদন এবং যাত্রার সাথে থিয়েটারের তফাৎ সুক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে। আমরা যদি একটু অনুসন্ধানী পাঠ করি এ অংশে, লোকসাহিত্যের তত্ত্বীয় এবং ব্যাবহারিক কিছু দিক আমাদের চোখে পড়ার কথা। সেগুলো নিয়েই আলাপ।

Download Now

আরও পড়ুনঃ গল্পগুচ্ছ Read Online | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | Golpo Guccho PDF

আগেকার দিনের যাত্রাগুলোয় দূরদূরান্ত থেকে যাত্রার দল আসত স্থানীয় আপামর জনগোষ্ঠীর চিত্তবিনোদনের খোরাক যোগাতে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে আমরা দেখি গাওদিয়া গ্রামে কলকাতা থেকে যাত্রাদল বিনোদিনী অপেরা পার্টি এসে উপস্থিত হয়েছে। সে দলের বিএ ফেল হলেও দলের দুজন বিএ পাস করা অভিনেতা আছে। মানিক উত্তেজিত জনতা আর যাত্রাদলের অধিকারীর মধ্যে যে সংলাপ দিয়েছেন—

‘থেটার, অ্যাঁ?’

‘উঁহু, যাত্রা। অপেরা-পার্টি নাম যে?’

‘তাই ভালো। যাত্রাই ভালো।’

তাতে থিয়েটার আর যাত্রার মধ্যকার ভেদরেখা স্পষ্ট। সাদাচোখে বোঝা যাচ্ছে, আবেদন বিচারে যাত্রার কাছে থিয়েটার নস্যি। এবারে তার কারণ অনুসন্ধান।

প্রথমত, গাওদিয়া গ্রাম। একেবারেই অজগ্রাম। শশী কলকাতায় পড়াশোনা চুকিয়ে গ্রামে এসে ডাক্তারি করে। এখানে সাধারণ মানুষের ভ্রান্ততা-অজ্ঞানতা তাকে বিরক্ত করে তোলে প্রতিনিয়ত। আমরা উপন্যাসের যত গভীরে যাব, দেখব গ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থা কতটা নাজুক। শশীর ডাক্তারির ভিজিটের দিকে তাকালেই সে নাজুকতা কতকটা স্পষ্ট হয়। তার ওপর সেকেলে মানসিকতার লোকজনে ভরভরতি এই গ্রাম্যসমাজ। বলা যায় এঁরা মাটিঘেঁষা গোছের মানুষ।

এখন, এই সমাজের মানুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে যাত্রার গ্রহণযোগ্যতাই বেশি হওয়া কি অস্বাভাবিক? থিয়েটারে সাধারণ গোছের চরিত্র, পোশাক এবং ভাষিক বিন্যাসে যে শিল্পের ছোঁয়া, তার কদর করতে জানা এই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর পক্ষে কতটা স্বাভাবিক?

আরও পড়ুনঃ মেঘনাদবধ কাব্য PDF | Meghnath Vadh Kabbo Summary in Bengali

দ্বিতীয়ত, মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কথা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি এ পর্যায়ে। সেই যে ভিখু, সে এক অসংস্কৃত মননের মানুষ। তার চরিত্রে যে আদিমতা তা কিন্তু তার চারিত্রিক মননেরই অবদান। সে কারণে আশ্রয় খুঁজতে এসে সে ধর্ষকামী হয়ে ওঠে। এখানে এই যে যৌনচেতনা, তার ভিত্তি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের ওপর।

যাত্রাপালা চিত্তবিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মানুষের মনস্তত্ত্বের যৌনপ্রবৃত্তির পালেও হাওয়া লাগায়। উপর্যুক্ত সংলাপে (গ্রামবাসীর) থিয়েটারের প্রতি যে অবজ্ঞা, অরুচি এবং বিদ্রূপ, তা থিয়েটারের পরিচ্ছন্ন, সভ্য প্রায় যৌনচেতনাহীনতার প্রতিই প্রকারান্তরে।

আবার যখন তারা আশ্বাস পেল এ থিয়েটার নয়, যাত্রা— তখন তারা যাত্রাকেই ভালো বলছে। তাদের বিরক্তি কেটে গেছে তখন বোধকরি ফ্রয়েডীয় যৌনচেতনার তৃপ্তিতেই।

যাত্রাদলের সদস্য হিসেবে কুমুদকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক শশী। তার বিস্ময়ে কুমুদের স্বীকারোক্তি। নাট্যকলায় যাকে বলে লাউড অ্যাক্টিং তা বাঙলা লোকনাট্যে যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কুমুদের সংলাপ—

‘করি বৈকি যাত্রা। প্রবীর সাজি, লক্ষ্মণ সাজি, চন্দ্রকেতু সাজি, আরও কত কি সাজি। গলা ফাটিয়ে বলি। সাত শ মেডেল পেয়েছি।’—

-এ সেটি পরিষ্কার। থিয়েটারে এ ব্যাপারটির গুরুত্ব সেভাবে নেই। সেদিক থেকে এটাও একটা মৌলিক পার্থক্য দুই আঙ্গিকের। আমাদের চোখ এড়ায় না যে মানিক তাঁর উপন্যাসে এই সুক্ষ্মতম সত্যটিকেও টুলে আনতে ছাড়েননি। প্রসঙ্গত কুমুদের ভেতরকার চরিত্রধারণের মনোবৃত্তিও উপন্যাসে পরিষ্কার। গ্রামে এসে শশীর সংলাপের বিপরীতে প্রথম সংলাপেই কুমুদ বুঝিয়ে দেয় অভিনয়ে তার প্রাণান্তকর আন্তরিকতা— সে কুমুদ নয়, সে প্রবীর। এ বিষয়টি যাত্রার চরিত্রের প্রতি পাত্রের আত্মনিবেদনের ব্যাপারটি তুলে ধরে।

আরও পড়ুনঃ চোখের বালি পিডিএফ রিভিউ | বাংলা সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস

প্রসঙ্গত প্রলেতারিয়েতের চিত্তবিনোদনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে একত্রে বসে উপভোগ করবার তুমুল আকর্ষণ। আর মাধ্যম যদি হয় যাত্রা তাহলে ত কথাই নেই! এ বিষয়টি মানিক ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় তুলে ধরতে ভুলে যাননি। সাধে কি আর ধোপ দুরস্ত কাপড়চোপড় পরে সবার চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন মোক্ষদার মতো নরমশরম বৃদ্ধাও? মানিকের লেখায় এসেছে—

মোক্ষদাকে একখানা ফরসা কাপড় পরিতে দেখিয়া পরান জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমিও যাবে নাকি মা, যাত্রা শুনতে?

‘না, আমার আবার যাত্রা কি!’

জোর করিয়া ধরিলে মোক্ষদা যাইতে রাজি আছে। কিন্তু এরা কেউ যাইতে বলিবেও না। আগে হইতেই মোক্ষদা তাহা জানে তাই সাঁতরাদের বুড়ি পিসির সঙ্গে সে আগেই পরামর্শ ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। তারা দুজনে যাত্রা শুনিতে যাইবে। বাড়ি আসিয়া মোক্ষদা তাহা হইলে বলিতে পারিবে, যাত্রা শুনিবার শখ তাহার একটুও ছিল না। কি করিবে আর একজন টানিয়া লইয়া গেল। জোর করিয়া টানিয়া লইয়া গেল।

তালপুকুর-তালবন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র রচনাকল্পে একটা তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। নায়ক-নায়িকার পূর্বরাগ-অনুরাগ-বিরাগের এক নির্বিকার প্রতিষ্ঠান বোধকরি তালপুকুর-তালবন। কুমুদ-মতির প্রেম থেকে শশী-কুসুমের বিচ্ছেদ— সবই ঠিকানা খুঁজেছে বুঝি তালপুকুর-তালবনে। কুসুম মতিকে অভিশাপ দেয়—

‘তুই তালপুকুরে ডুবে মর্‌। মরে শাঁকচুন্নি হয়ে থাক।’

ঠিক ঠিক তা-ই হয়। তালপুকুরের ধারেই তালবনে সাক্ষাৎ ঘটে কুমুদ-মতির, যেখানে নির্বিষ সাপেদের অভয়ারণ্য। মানিকেরই লেখা সমসাময়িক কালের একটি গল্প ‘নেকি’। সে গল্পে মানিক লিখেছেন—

… বাকিটুকু কিন্তু গ্রামছাড়া কিছু নয়। বাড়িঘর সবই প্রায় চাঁচের বেড়া এবং টিনের ছাদ দেওয়া। কোনো কোনোটার ভিটেটুকু মাত্র পাকা বাঁধানো। শুধু তাই নয়, গ্রামের যা প্রধান প্রধান লক্ষণ, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আমকাঁঠালের বাগান, পুকুর-ডোবা ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল বেতবন থেকে আরম্ভ করে সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বেজি এবং টিকটিকির রাজসংস্করণ গোসাপ পর্যন্ত সমস্তই আছে।

বাড়িটির পিছনে প্রকাণ্ড এক আমবাগান, তারই একদিকে ডোবাসংস্করণ একটি পুকুর। এ গল্পের আরম্ভ ওইখানে, একদিন বেলা প্রায় দশটার সময়।

নেকি আর অশোকের যেখানে দেখা, অনুমান করতে পারি সে গল্পটিই কুমুদ আর মতির হয়ে গেছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য়।

আরও পড়ুনঃ শেষের কবিতা PDF | সারসংক্ষেপ | Shesher Kobita | Read Online

কুমুদ আর মতির প্রেমের আখ্যান নিয়ে মানিক সম্ভবত আলাদা বই লিখবার কথা ভেবেছিলেন। সেটা হয়নি। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসে হেরম্ব যেরকম নিজস্ব ব্যাখ্যা দেয় প্রেমের, কুমুদের প্রাকজীবনে সেরকম একটা ব্যাখ্যার অবকাশ বোধকরি জয়া চরিত্রের অবতারণায়। মানিকের গদ্যের উন্মুক্ত সমাপ্তির বিষয়টি বিশেষ করে কুমুদ-মতির অর্ধসমাপ্ত আখ্যানে প্রতীয়মান। যে আরোপিত জীবন কুমুদ ভালোবেসে মতিকে দিতে চেয়েছিল তা বছরদুই আগের লেখায় অশোকই সুপ্রিয়াকে কিছুটা দিয়েছিল। প্রভেদ বুঝতে পারা আর না পারায়।

এদিকে সেই সুপ্রিয়ার কাছে যা ছিল অনেকটাই রোগমুক্তির ওষুধের মতো, বিন্দুর ক্ষেত্রে তা হয়েছে অপ্রকৃতিস্থতার উপলক্ষ। ত্রিশের দশকের কলকাতার বাবু কালচার গাওদিয়া গ্রামের ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য, সেটিই বোধহয় দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন মানিক। সেক্ষেত্রে ভাই হিসেবে শশীর ভূমিকাকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। পাশাপাশি তার মধ্যে সহজ বাস্তববাদী ধ্যানধারণার বিশেষ প্রশংসা করতে হয়।

‘রাইট টু লাইফ’ বলে একটা ধারণা রয়েছে আইনশাস্ত্রে। বলা হয়ে থাকে মানুষের বেঁচে থাকবার জন্য ক্ষুদ্র পরিমাণে প্রয়োজনীয় জিনিসটির অভাবও ‘রাইট টু লাইফ’ অর্থাৎ জীবন ধারণের অধিকার ধারণার পরিপন্থী। এক্ষেত্রে সব প্রয়োজনই মানুষের মৌলিক প্রয়োজন।

সুশৃঙ্খল, সুন্দর, সুস্থ জীবনধারণের জন্য যা যা কিছু প্রয়োজন, তার একটিরও অভাব ঘটলে, সে জীবনের কোনো অর্থ নেই। সেক্ষেত্রে বঞ্চিত মানুষটির স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটাই শ্রেয়। মানিকের মত এমনই ছিল। তাঁর এরূপ কঠোর বাস্তববাদী চেতনা অস্তিত্বচেতনাকে অস্বীকার করলেও, এ চেতনাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এদিক থেকে মানিকের সমকালে রচিত গল্প ‘আত্মহত্যার অধিকার’-এর উল্লেখ করা যেতে পারে।

শশীর চরিত্রে যে বাস্তববাদী মনন, সে জায়গা থেকেই বিন্দু, পাগল দিদি অথবা সেনদিদিদের স্বাভাবিক মৃত্যুকে সহজেই মেনে নিয়েছে সে। মানতে তার কষ্ট হয়েছে নিঃসঙ্গতা। এই অপরিবর্তনীয় নিয়তিবাদেই আগাগোড়া ঢাকা পড়ে যাওয়া কালজয়ী উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।

© রেজওয়ান আহমেদ


আরও পড়ুনঃ পদ্মানদীর মাঝি PDF | সারাংশ | Padma Nadir Majhi Book Review

Tags:
x
error: Content is protected !!