যেকোন বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পেতে অনুগ্রহ করে আমাদের PDF Download সেকশনটি ভিজিট করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বইয়ে সাজানো হচ্ছে আমাদের এই অনলাইন পাঠশালা। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
তিন পর্বের ধারাবাহিক এই লেখায় আজ আমরা জানবো একজন আবু ইসহাকের গল্প , যাকে আহমাদ মোস্তফা কামাল ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ হিসেবে দেখেছেন। আশা করছি পুরো লেখাটি আবু ইসহাক সম্পর্কে জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ আহমাদ মোস্তফা কামালকে নিভৃতে থাকা প্রিয় এই কথাসাহিত্যিক সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক লেখার জন্য।
আবু ইসহাক হচ্ছেন বাংলাদেশের সেই আশ্চর্য লেখক যিনি লেখক-সমাজের প্রথমশ্রেণীর সদস্য হয়েও এই সমাজের সঙ্গে কোনোদিন সম্পর্ক রক্ষা করে চলেননি। শক্তি ছিল তাঁর, বিচ্ছিন্ন থেকেও দেশের অন্যতম প্রধান লেখকে পরিণত হবার ক্ষমতা ছিল, তবু তাঁর নিভৃতিচারিতা তাঁকে পাঠক ও সহযাত্রী লেখকদের মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে দেয়নি। আমাদের সাহিত্যের ভুবন এখনও এতটা ঋদ্ধ হয়ে ওঠেনি যে, একজন নিভৃতচারী লেখককে তাঁর শক্তিমত্তার কারণে সামনে নিয়ে আসবে। মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯৪৬ সালে, তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য-দীঘল বাড়ী।
প্রকাশক না পেয়ে বছর-পাঁচেক পরে লেখেন রহস্যোপন্যাস জাল, কিন্তু সেটা প্রকাশের আগেই সূর্য-দীঘল বাড়ীর প্রকাশ ঘটে, এবং অচিরেই পরিণত হন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখকে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, খুব বেশি সামনেও তাকাননি তিনি। যে-পরিমাণ সক্রিয়তা-সচলতা-নিরবচ্ছিন্নতা থাকলে একজন লেখকের পক্ষে সবসময় পাঠক এবং সহযাত্রী ও উত্তরসূরি লেখকদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা সম্ভব হয় তা তাঁর ছিল না কোনোদিন। তিনি যে কতখানি অনিয়মিত ছিলেন সেটা তাঁর গ্রন্থগুলোর প্রকাশকালের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
আরও পড়ুনঃ নির্বাচিত গল্প সমগ্র | আবু ইসহাক | Nirbachito Golpo Somgro PDF
১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস সূর্য-দীঘল বাড়ী। এরপর প্রথম গল্পগ্রন্থ হারেম ১৯৬২ সালে । কিন্তু পাঠকরা বইটির মুখ দেখার আগেই তা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়— এই সংবাদ লেখক আমাদেরকে জানাচ্ছেন বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের সময়— কুড়ি বছর পর, ১৯৮২ সালে। তা এতদিন লাগল কেন দ্বিতীয় সংস্করণ হতে? লেখক জানাচ্ছেন— তাঁর কাছে পাণ্ডুলিপিটির কোনো কপি ছিল না, অতএব নানা জায়গা থেকে গল্পগুলো জোগাড় করতে করতে বিশ বছর চলে গেছে! প্রথম গল্পগ্রন্থের এই পরিণতির ফলেই হয়তো দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থটি একটু তাড়াতাড়ি আলোর মুখ দেখেছিল । ১৯৬৩ সালে এটি— মহাপতঙ্গ— প্রকাশিত হয়। তারপর দীর্ঘ এক বিরতি।
১৯৮২ সালে হারেম-এর দ্বিতীয় সংস্করণ— এক অর্থে প্রথম সংস্করণই, কারণ এটিই পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল, তারপর ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ। এটির মুখবন্ধে লেখক আবার আমাদের জানাচ্ছেন- উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৬০ থেকে ১৯৮৫। পঁচিশ বছর! এক অর্থে এটিই তাঁর শেষ রচনা। কারণ ১৯৮৯ সালে তার রহস্যোপন্যাস জাল প্রকাশিত হলেও এটি তিনি লিখেছিলেন সেই ৫০ দশকের গোড়ার দিকে। তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ— স্মৃতি বিচিত্রা, প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। সাকুল্যে এই তাঁর রচনা। অর্থাৎ দুটো উপন্যাস, দুটো গল্পগ্রন্থ, একটি রহস্যোপন্যাস, একটি স্মৃতিকথা ।
প্রায় ষাট বছরের দীর্ঘ লেখকজীবনে এই রচনার পরিমাণকে আমরা কী বলব— সামান্য না নগণ্য? অবশ্য সেই ৬০-দশক থেকেই তিনি একটি বড় কাজ করছিলেন— বাংলা একাডেমী সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান রচনার কাজ— মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেটা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করে গেছেন। যা হোক, প্রশ্ন হচ্ছে— এত বিচ্ছিন্নতা, এত নিভৃতিচারিতা সত্ত্বেও কারো পক্ষে আবু ইসহাককে ভুলে থাকা সম্ভব হয়নি কেন? আমাদের কথাসাহিত্যের কথা উঠলেই কেন অনিবার্যভাবে তাঁর নাম এসে যায়?
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন— তাঁর এই অনিবার্য অবস্থান সত্ত্বেও তাঁকে আমরা কোথাও ডাকিনি কেন? কেন তাঁকে নিভৃতিচারিতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে দিয়েছি? এর কারণ হয়তো এই যে, বাংলাদেশের সাহিত্যের যারা পৃষ্ঠপোষক সেই মধ্যবিত্তদের জন্য তাঁর রচিত সাহিত্যকর্ম কেবল অস্বস্তি আর অশান্তিই উৎপাদন করত। ‘ওসব’ পড়ে কোনো ‘আরাম’ পাওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের ‘লজ্জাজনক’ শেকড় আবিষ্কার করে বরং শিউরে উঠতে হত। কারণ, আজকের যারা মধ্যবিত্ত ৪০/৫০/৬০ বছর আগেও তারা স্রেফ এক ‘গ্রাম্য লোক ছাড়া আর কিছুই ছিল না— আবু ইসহাক সেটাই চিহ্নিত করে দেখাতেন। আর ওটাই আসল ব্যাপার।
আরও পড়ুনঃ পদ্মার পলিদ্বীপ আবু ইসহাক PDF | Poddar Poli Dip by Abu Ishak
আবু ইসহাক যা লিখে গেছেন তা আমাদের মধ্যবিত্ত সাহিত্যরুচির পক্ষে হজম করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তা, কী লিখেছেন তিনি? সবাই জানেন— তাঁর লেখার, বিশেষ করে উপন্যাসের, প্রধান বিষয় আমাদের গ্রাম— সভ্যতার ছোঁয়াবিহীন সেই প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম, গ্রামের মানুষ, গ্রামীণ সমাজ ও জীবন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে : এ আর এমন কী নতুন বিষয়? আমাদের আর কোনো লেখক কি গ্রাম নিয়ে লেখেননি? বিস্তর লিখেছেন। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আবু ইসহাকের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। আমরা যে গ্রাম নিয়ে লিখি— সেটা আমাদের স্মৃতির গ্রাম, শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নময় চোখে দেখা মমতাময়ী গ্রাম— আর সেটাকে আমরা স্থাপন করি বর্তমানে। ফলাফল হয় অদ্ভুত । কেউ মিলিয়ে দেখতে গেলে বিপদে পড়ে যান— কারণ বর্তমানের গ্রাম তো আগের মতো নেই, স্মৃতির সেই গ্রামটিকে বর্তমানে স্থাপন করলে চলবে কীভাবে?
এমনকি ৩০/৪০ বছর আগে দেখা গ্রামটিকে আমরা যেভাবে মনে ধরে রেখেছি, ওই সময়ও হয়তো সেটি সেরকম ছিল না, কৈশোরের স্বপ্নময় চোখে জনজীবনের দুঃসহ বাস্তবতা কিংবা অন্যান্য বীভৎস ব্যাপারগুলো হয়তো ধরাই পড়েনি। সেই গ্রামের প্রকৃত রূপ তাহলে কীভাবে আঁকা যাবে? এই ক্ষেত্রে আবু ইসহাক ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনিও গ্রামকে দেখেছেন শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে। শুধু উপরিতলের দেখাই নয়, গ্রামে বসবাসের ফলে গ্রামের মানুষ, সমাজ ও জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। ভালো-মন্দ-সুন্দর-অসুন্দর কিছুই তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু সেই গ্রামকে আঁকার সময় ভুল করেও সেটাকে বর্তমানে টেনে আনেননি। গ্রামজীবন অনেক বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ, এসেছে অনেক অবকাঠামোগত পরিবর্তন। কিন্তু তাঁর গ্রামগুলো যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের, মানুষগুলো যেন এ-যুগের নয়। এ-ব্যাপারে তাঁর অবস্থানও যুক্তিসঙ্গত।
আরও পড়ুনঃ সূর্য দীঘল বাড়ি | আবু ইসহাক বই রিভিউ | Surja Dighal Bari Book PDF
তিনি মনে করতেন— মানুষের জীবনে যে-পরিবর্তন এসেছে তা উপরিকাঠামোর পরিবর্তন, মানসজগতে তারা একই রকম রয়ে গেছে। সেই প্রাচীন বিশ্বাস, অনড় মূল্যবোধ, সংস্কার-কুসংস্কার তারা আজও বহন করে চলেছে। এমনকি গ্রামের যে-লোকগুলো ‘শিক্ষিত হয়ে শহরবাসী হয়েছে, তারাও মনোজগতে ওই গ্রামের মানুষই। আধুনিক মানুষ হওয়ার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে— বিজ্ঞানমনস্কতা, সেটা এদেশের মানুষের মধ্যে নেই বললেই চলে। তিনি মনে করতেন— শহুরে শিক্ষিত মানুষগুলোকে বুঝতে হলে আগে ওই প্রাগৈতিহাসিক গ্রামগুলোর প্রাচীন মানুষদেরকে বুঝতে হবে। আমাদের পশ্চাৎপদতা ও অনগ্রসরতার কারণ নইলে বোঝা যাবে না। আর এভাবেই তিনি আজকের শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের শেকড় খুঁজে খুঁজে চলে গেছেন গ্রামে।
কী লিখছেন, কেন লিখছেন সেটা তিনি পরিষ্কারভাবে জেনে-বুঝেই লিখেছেন— কিন্তু ভুলে যাননি সাহিত্যের শিল্পমূল্যের কথাও। নিজের মতাদর্শ তাই তিনি চাপাননি কোথাও। তাঁর গল্প-উপন্যাস তাই কোথাও টলে পড়ে না, ঝুঁকে পড়ে না, ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়।
আহমাদ মোস্তফা কামাল ডিসেম্বর ২০০৫